এই প্রকারের সুরম্য গৃহতলে বসিয়া একমনে ঈসা খা কি চিন্তা করিতেছেন। ঈসা খাঁর প্রিয়তমা ভগ্নী ফাতেমা অনেকক্ষণ হইল ঘরে প্রবেশ করিয়া বিছানার নিকট দাঁড়াইয়া বহিগুলি নাড়াচাড়া করিতেছে, তবুও ঈসা খাঁর চমক নাই। ফাতেমা আর কখনও তাহার ভ্রাতার এই প্রকার অন্যমস্কতা দেখে নাই। অন্যান্য দিবস ফাতেমা আসিতেই ঈসা খাঁ তাহাকে কত প্রকার প্রশ্ন করেন। উভয়ের মধ্যে প্রগাঢ় সম্প্রীতি ও গভীর ভালবাসা। প্রত্যেক দিন রাত্রেই ঈসা খাঁর পরিশ্রান্ত মস্তিস্ক ও হৃদয়ের শান্তি ও প্রীতি সঞ্চারের জন্য ফাতেমাকে সেতার বাজাইয়া গান গাহিতে হয়। ফাতেমা অতি সুন্দররূপে গাহিতে এবং বাজাইতে শিখিয়াছে। আহমদনগরের প্রসিদ্ধ সঙ্গীতাচার্য করতলব খাঁ তিন বৎসর পর্যন্ত ফাতেমাকে গীতবাদ্য শিক্ষা দিয়াছেন। ফাতেমার ধর্ম ও শান্তি-রসাশ্রিত গান শুনিলে পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হয়। ফাতেমা এত দ্রুত যাদুবশে নাচিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া অতৃপ্ত মদিরাবেশময় ঝঙ্কার দিতে থাকে। ফাতেমা এত দ্রুত অঙ্গুলী চালনায় অভ্যস্ত যে, মনে হয় তাহার অঙ্গুলী স্থির রহিয়াছে। সেতার আপনা আপনি বাজিতেছে। তারপর সেতারের ঝঙ্কার ও মধুবর্ষিণী মূচ্ছনার সহিত যখন তার সুধাকণ্ঠ গাহিয়া উঠে, তখন মনে হয় স্বর্গরাজ্য তরল হইয়া ধরাতলে বহিয়া যাইতেছে। কিন্তু আজ অনেকক্ষণ হইল ফাতেমা আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ভ্রাতার ইঙ্গিত না পাইলে সে কোনও দিন বসে না। বসে না যে, সে শুধু ঈসা খাঁর সুমধুর সম্ভাষণের জন্য ঈসা খাঁ তাহাকে আদর করিয়া সস্নেহে বসিতে বলিবে বলিয়া। ফাতেমা যখন দেখিল যে, ঈসা খাঁ জানালার দিক হইতে মুখ ফিরাইতেছেন না, তখন একখানি পুস্তকের দ্বারা আর একখানি পুস্তকে আঘাত করিল। আঘাতের শব্দে ঈসা খাঁ চমক ভাঙ্গিয়া গেল। নক্ষত্র খচিত নীলাকাশের প্রান্ত-বদ্ধ-দৃষ্টি ফিরাইয়া গৃহমধ্যে চাহিলেন। দেখিলেন, সমস্ত ঘর ঝাড়ের আলোকে উজ্জ্বল হইয়া শোভা পাইতেছে। আর সেই গৃহের কার্পেটমন্ডিত মেঝেতে দাঁড়াইয়া ফাতেমা ঈষৎ বঙ্কিম অবস্থায় তাঁহার শুভ্র শয্যার পার্শ্বে পুস্তক লইরা ক্রীড়া করিতেছে। তাহার অলকাবলী বিমুক্ত। তাহার বদনমণ্ডল পুণ্যের জ্যোতিঃতে স্নিগ্ধ। দেখিয়া মনে হয় যেন জ্যোৎস্নার রাজ্যে মূর্তিমতী বালিকা প্রতিমা শান্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়াইয়া আছে। ফাতেমার বয়স সবে দ্বাদশ হইলেও এবং এখনও তাহার যৌবনপ্রাপ্তির বিলম্ব থাকিলেও তাহার মুখমণ্ডল বেশ ভাবুকাতাপূর্ণ। সে ভাব অতি নির্মল-অতি পবিত্র-বুঝিবা স্বর্গরাজ্যের ঊর্ধ্বের। ঈসা খাঁ মুখ তুলিয়া মধুর স্বরে বলিলেন, “কি গুল, কখন এসেছিস?” পাঠক জানিয়া রাখিবেন, ঈসা খাঁ আদর করিয়া ফাতেমাকে গুল অর্থাৎ ফুল বলিয়া ডাকিতেন।
ফাতেমাঃ হাঁ মিঞা ভাইজান! আপনি আজ একমনে কি ভাবছিলেন? আমি অনেকক্ষণ এসেছি।
ঈসা খাঁ:তা আমাকে ডাকিস নাই কেন? আমি না বল্লে কি বসতেও নেই? আকাশের দিকে চেয়ে মনটা যেন কোন দেশে চলে গিয়েছিল। তুই এইবার সেতার নিয়ে বসে যা’। আজ খুব ভালো বাজাবি। মনটা বড় অস্থির।
ফাতেমা তখন সেতার লইয়া একখানি মখমলমণ্ডিত রূপার কুর্সীতে চম্পক বিনিন্দিত আঙ্গুলে মেজরাফ পরিয়া সেতারের বক্ষ স্পর্শ করিল। সে ললিত-কোমল করপল্লবের ইঙ্গিতে সেতারের সুপ্ত তন্ত্রী নাচিয়া উঠিয়া বাজিতে লাগিল। সেতারের মধুর ঝঙ্কারে আলোক-উজ্জ্বল গৃহ যেন চঞ্চল হইয়া উঠিল। ঝাড়ের কর্পূর-মিশ্রিত শত মোমবাতির শুভ্র শিখা মৃদু কম্পনে কাঁপিতে লাগিল। সেতারের মনোমদ মধুর তরল ঝঙ্কারে ঈসা খাঁর এক আত্মীয় রমণী এবং আয়েশা খানম সাহেবা ও অন্যান্য অন্তঃপুরিকাব্য আসিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রত্যহই এইরূপ হইত। ফাতেমার হাতে সেতার বাজিলে কেহই স্থির থাকিতে পারিত না। বিশেষতঃ ফাতেমার ধর্ম ও ঐশী-প্রেম সম্পর্কীয় গজল শুনিয়া পুণ্য সঞ্চয়ের আশায় আয়েশা খানম সেতার ঝঙ্কার দিলেই আসিতেন। ঈসা খাঁ আয়েশাকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া চরণ চুম্বন করিলেন এবং একখানি স্বর্ণ-বিমণ্ডিত দ্বিরদ-রদ-রচিত বিচিত্র আসনে আম্মাজান’কে বসিবার জন্য মুখমলের মসনদ পাতিয়া দিলেন। আয়েশা খানম তাঁহার প্রীতিপ্রফুল্লতা-মন্ডিত শান্ত অথচ গম্ভীর সৌন্দর্যে গৃহ আলোকিত করিয়া রাজরাজেশ্বরীর ন্যায় আসন গ্রহণ করিলেন। অন্যান্য রমণীরাও যথাযোগ্য আসন পরিগ্রহ করিলেন। সুবিশাল পুরী নীরব ও নিঃশব্দ। কেবল আসাদ-মঞ্জিলে (সিংহ-প্রাসাদে) সেতারের মধুর নিক্কণ কাঁপিয়া কাঁপিয়া চতুর্দিকে অমৃত-বৃষ্টি ঝরিতেছে। এক গৎ বাজাইবার পর ফাতেমা গজল ধরিল। সে পীযুষ-বর্ষিণী পারস্য ভাষার গজলের বঙ্গানুবাদ দেওয়া হইল। বলা বাহুল্য, পারস্য ভাষার অমৃতত্ত্ব ও ছন্দ-ঝঙ্কার বঙ্গানুবাদ কেহ অনুসন্ধান করিবেন না।
সঙ্গীত
“হে শিব সুন্দর! চির মনোহর পরম পুরুষ পরাৎপর!
হে নিখিলশরণ ভুবনঞ্জন পতিতপাবন ত্রিগুণাকর!
গগনে গগনে পবনে পবনে তোমারি মহিমা ভাসে,
কাননে কাননে কুসুমে কুসুমে তোমারী মাধুরী হাসে।
নদ নদী জল বহে কল কল ঢালিয়া অমিয়-ধারা,
কুঞ্জু কাননে তোমার গায়নে বিহগ আপনা-হারা।
নীল আকাশে তারকা প্রকাশে তোমারী মহিমা রটে,
সবারি মাঝে তুমিই ফুটিছ তুমিই হাসিছ বটে!
(শুধু) আমারি হৃদয় র’বে কি আঁধার? তাও কি কখনো হয়,
এই যে গো তুমি হৃদয়ের মাঝে, জয় জয় তব জয়।”