ঈসা খাঁ নামাজ পড়িয়া মসজিদ হইতে ফিরিতেই শিবনাথ কুর্ণিশ করিয়া পত্র দিল। ঈসা খাঁ রুমাল খুলিয়াই বুঝিতে পারিলেন, স্বর্ণময়ীর পত্র। পত্রখানি হাতে করিতেই ঈসা খাঁর আপাদমস্তকে কি যেন এক বিদ্যুৎ-তরঙ্গ প্রবাহিত হইল। ঈসা খাঁ সহসা শিহরিয়া উঠিলেন। পত্র খুলিয়া উপরের স্তরের লেখা পড়িয়াই বাটীতে প্রবেশ করিলেন। শিবনাথের খাইবার থাকিবার ভালো বন্দোবস্ত করিয়া দিতে হিন্দু-অতিথিশালার দারগাকে আদেশ করিয়া গেলেন। শিবনাথ বিস্ময়-বিস্ফোরিত নেত্রে রাস্তার দুই পার্শ্বে স্থাপিত বীর-পুরুষদের অশ্বারূঢ় প্রস্তর-মূর্তি দেখিতে দেখিতে অতিথিশালায় যাইয়া উপস্থিত হইল।
রাত্রি এক প্রহর। ঈসা খাঁ হস্তীদন্ত-নির্মিত একখানি আরাম-কুর্সীতে বসিয়া ভাবিতেছেন। গৃহের মধ্যে একশত ডালবিশিষ্ট ঝাড় জ্বলিতেছে। প্রকান্ড কক্ষ, কক্ষের ছাদ স্বর্ণ ও রৌপ্যের লতাপাতায় সুশোভিত। ছাদের কড়ি, বরগা কিছুই দৃষ্ট হইতেছে না। বলা বাহুল্য যে, প্রস্তুরের কড়ি বরগা ছাদের সহিত অদ্ভুত কৌশলে মিশাইয়া দেওয়া হইয়াছে। দেওয়ালে সুবৃহৎ দর্পণ, প্রস্তুরের নানা বর্ণের ফুল এবং বহুমূল্য চিত্ররাজি শোভা পাইতেছে। সম্রাজ্ঞী রাজিয়ার কৃপাণপাণি অশ্বারূঢ়া বীর্যবতী মূর্তিখানি অতি চমৎকার শোভা পাইতেছে। রাজিয়া যেমন অতুলনীয়া সুন্দরী তেমনি অসাধারণ সাহসিনী ও তেজস্বিনী। তাঁহার মুখ-চোখ হইতে প্রতিভার আলো যেন ঠিকরিয়া পড়িতেছে। আর একটি চিত্রে মহাবীর রোস্তম তরবারি আঘাতে এক ভীষণ আজদাহা সর্পকে বিনাশ করিতেছেন। রোস্তমের অসাধারণ বীরত্ব ও তেজ ছবিতে চমৎকার রূপে ফুটিয়াছে। আর একটি চিত্রে উদ্যান মধ্যে বসিয়া ‘মজনু’ বীণা বাদন করিতেছেন; দুঃখিনী প্রেমোন্মাদিনী ‘লায়লা’ সেই মধুর বীণাধ্বনি শ্রবণ করিতেছেন। লায়লার দুই চক্ষু বহিয়া তরল মুক্তাধারার ন্যায় অশ্রুধারা নির্গত হইতেছে। উদ্যানের ফুল ও পক্ষীগুলি মুগ্ধ হইয়া রহিয়াছে। আর একখানি চিত্রে ফরহাদ প্রেমোন্মত্ত চিত্রে পাহাড় কাটিতেছেন। অনবরত দৈহিক পরিশ্রমে ফরহাদের সুকুমার তনু ক্ষীণ ও মলিন হইয়া পড়িয়াছে। শিরী বিষন্ন চিত্তে করুণনেত্রে দূরস্থ প্রাসাদের ছাদ হইতে তাহাই দর্শন করিতেছেন। তাঁহার চক্ষু হইতে প্রিয়তমের প্রতি প্রেম ও সহানুভূতির কি ভুবমোহন জ্যোতিঃ নির্গত হইতেছে।
একখানি চিত্রে একজন দরবেশ স্থানীয় লোকদিগকে ইসলাম গ্রহণ এবং তাঁহার সহায়তা করিতে আহবান করিতেছেন। সমবেত লোকগণ সকলেই নীরব ও নিস্তব্ধ। কিন্তু ষোড়শবর্ষ বয়স্ক এক যুবক স্বর্গীয় দীপ্তিঝলসিত তেজোময়ী মূর্তিতে দণ্ডায়মান হইয়া বিশ্বাসের কলেমা পাঠ করতঃ অসি উত্তোলনপূর্বক আনুগত্য জ্ঞাপন করিতেছেন। আর একখানি চিত্রে বালক রোস্তম, এক মত্ত শ্বেতহস্তীকে পদাঘাতে বধ করিতেছেন। একখানি চিত্রে রাজ্যচ্যুত ছদ্মবেশী ইরাণেশ্বর জামশেদ, জাবলস্থানের উদ্যানে শিলাসনে উপবিষ্ট। সম্মুখে জাবলস্তানের অপূর্ব সৌন্দর্যশালিনী রাজকুমারী তাঁহাকেই স্বর্কীয় আকাঙ্খিত প্রেমাস্পদ জামসেদ জ্ঞানে সন্দেহ নিরাকরণার্থ সম্রাট জামশেদের একখানি চিত্র লইয়া পরম কৌতূহল এবং প্রেমানুরাগ-ফুল্ল-নয়নে আড়াল হইতে আকৃতির সহিত মিলাইয়া দেখিতেছেন। চিত্রে কুমারীর এক পার্শ্বে একটি নৃত্যশীল ময়ূর এবং অন্য পার্শ্বে একটি মনোরম মৃগ শোভা পাইতেছে। আর একখানি চিত্রে হপ্তখানার সুসজ্জিত নিভৃত কক্ষে প্রেম-উম্মাদিনী জোলেখা সুন্দরী পিপাসাতুর চিত্তে ইউসফের নিকট প্রেম যাচ্ঞা করিতেছেন-আর ধর্মপ্রাণ ইউসফ উর্ধ্বে অঙ্গুলী নির্দেশ করিয়া পরমেশ্বরের ক্রোধের কথা জোলেখাকে জ্ঞাপন করিতেছেন। উভয়ের মুখে স্বর্গ ও নরকের চিত্র। একখানি চিত্রে মরুনির্বাসিতা হাজেরা বিবি শিশুপুত্র ইসমাইলকে শায়িত রাখিয়া জলের জন্য চতুর্দিকে ছুটাছুটি করিতেছেন। এদিকে ইসমাইলের পদাঘাতে ভূমি হইতে এক নির্মল উৎসধারা বহির্গত হইতেছে। একজন স্বর্গীয় হুরী ইসমাইলের চিত্তবিনোদনের জন্য তাহার চোখে দৃষ্টি স্থাপন করিয়া হাস্যমুখে দাঁড়াইয়া আছেন। শিশু তাহার মুখপানে অনিমেষ আঁখিতে এমন সরল উদার অথচ কৌতূহলপূর্ণ মধুর দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে যে, সমস্ত পৃথিবী যেন অমৃত-ধারায় বসিয়া আছেন। সুন্দরীকুল-ললাম ‘সাবা’র রাজ্ঞী বিলকিস রূপের ছটায় দশদিক আলো করিয়া আগমন করতঃ কাচনির্মিত মেঝে সরোবর জ্ঞানে একটু বিচলিত হইয়া পার হইবার জন্য পরিধেয় বাস ঈষৎ টানিয়া ধরিয়াছেন। হযরত সোলেমান এবং অন্যান্য পারিষদমন্ডলী রাজ্ঞীর বুদ্ধিবিভ্রম দেখিয়া স্মিত হাস্য করিতেছেন। লজ্জার সহিত সৌন্দর্য ও অভিমান-গরিমা মিশিয়া রাজ্ঞী বিলকিসকে এক ভুবনমোহন সৌন্দর্য প্রদান করিতেছে। এই প্রকারের অসংখ্য কবি-চিত্ত-বিনোদন তসবীরে চতুর্দিকে প্রাচীরগাত্রে বেহেশতের শোভা বিকাশ করিতেছে।
গৃহের মধ্যে আতর গোলাপের গন্ধ ভুর ভুর করিতেছে। মেঝের উপর রাশি রাশি গোলাপ শোভা পাইতেছে। এক পার্শ্বে পালঙ্কের উপর বিছানা পাতা রহিয়াছে। বিছানার উপরে শ্বেত রেশমের মূল্যবান চাদরখানি ঝলমল করিতেছে। তিন পার্শ্বে কিঙ্খাপের বহুমূল্য তাকিয়া। জরীর কার্য করা সবুজ মখমলে তাহা ঢাকা। বিছানার এক পার্শ্বে শাহ্নামা, সেকেন্দারনামা এবং কয়েকখানি বহুমূল্য ইতিহাস শোভা পাইতেছে। পুস্তকগুলি সমস্তই মণিখচিত করিয়া পুবর্ণের পুরু পাতে বাঁধা। মণিগুলি দীপালোকে ঝক্ ঝক্ করিয়া জ্বলিতেছে।