- বইয়ের নামঃ রায়-নন্দিনী
- লেখকের নামঃ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী
- প্রকাশনাঃ জ্ঞান বিতরণী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১.রায়-নন্দিনী – প্রথম পরিচ্ছেদঃ মন্দিরে
যখন আসমুদ্রহিমাচল সমগ্র ভারতবর্ষের প্রতি নগরে, দুর্গে ও শৈলশঙ্গে ইসলামের অর্ধচন্দ্র শোভিনী বিজয়-পতাকা গর্ব-ভরে উড্ডীয়মান হইতেছিল,-যখন মধ্যাহৃ-মার্তণ্ডের প্রখর সভায বিশ্বপূজা মুসলমানের অতুল প্রতাপ ও অমিত প্রভাব দিগ্দিগন্ত আলোকিত, পুলকিত ও বিশোভিত করিতেছিল,-যখন মুসলমানের লোক-চমকিত সৌভাগ্য ও সম্পদের বিজয়-ভেরী, জলদমন্দ্রে নিনাদিত হইয়া সমগ্র ভারতকে ভীত, মুগ্ধ ও বিস্মিত করিয়া তুলিতেছিল যখন মুসলমানের শক্তি-মহিমায় অনুদিত বিব্দ্ধমান শিল্প ও বাণিজ্যে, কৃষি ও কারুকার্যে ভারত-ভূমি ধনধান্যে পরিপূর্ণ ও এবং ঋদ্বিশীতে বিমণ্ডিত হইতেছিল-যখন প্রতি প্রভাতের মন্দ সমীকরণ কুসুম-সুরভি ও বিহগ-কাকলীর সঙ্গে, মুসলমানের বীর্যশালী বাহুর নববিজয় মহিমার আনন্দসংবাদ বহন করিয়া ফিরিতেছিল-যখন মুসলমানের সমুন্নত শিক্ষা ও সভ্যতায় সুমার্জিত রুচি ও নীতিতে ভারতের হিন্দুগণ শিক্ষিত ও দীক্ষিত হইয়া কৃতার্থতা ও কৃতজ্ঞতা অনুভব করিতেছিল-যখন ব্রতেজঃ-সন্দীপ্ত দরবেশদিগের সাধনায় ইসলামের একত্ববাদ ও সাম্যের নির্মল কৌমুদীরাশি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন শতধারিবচ্ছিন্ন তেত্রিশ কোটি দেবোপাসনার তামসী-ছায়ায় কমাবত ভারতের প্রাচীন অধিবাসীদিগের হৃদয়ে এক জ্যোতির্ময় অধ্যাত্মরাজ্যের দ্বার প্রদর্শন করিতেছিল-যখন মুসলমানের তেজঃপুঞ্জ মূর্তি, উদার হৃদয়, প্রশস্ত বক্ষ, বীর্যশালী বাহু, তেজস্বী প্রকৃতি, বিশ্ব-উদ্ভাসিনী প্রতিভা, কুশাগ্রসূক্ষ্ম বুদ্ধি, জ্বলন্ত চক্ষু, দোর্দণ্ড প্রতাপ, প্রমুক্ত করুণা, নির্মল উদারতা, মুসলেমেতর জাতির মনে বিস্ময় ও ভীতি, ভক্তি ও প্রীতির সঞ্চার করিতেছিল-যখন উত্তরে শ্যাম-কাননাম্বর গগণ-বিচুম্বী তুষারকিরীটি হিমগিরি তাহার গম্ভীর মেঘ-নির্ঘোষে ও চপলা-বিকাশে এবং দক্ষিণ অনন্ত-বিস্তার ভারত-সমুদ্র অনন্ত কলকল্লোলে ও অনন্ত-তরঙ্গ বাহুর বিচিত্র ভঙ্গিমায়, মুসলমানের অবদান-পরস্পরার বিশুভ্র-যশোগাথা কীর্তন করিতেছিল,-যখন পৌরাণিত বংশমর্যাদাভিমানী চন্দ্র, সূর্য, অনল বংশীয় এবং রাঠোর ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়, শক, রাজপুত, জাঠগোত্রীয় অংসখ্য জাতি, মহিমান্বিত মুসলমানের গিরিশ্ঙ্গ-বিদলনকারী চরণতলে ভূনত-জানু ও বিনত-মস্তক হইতে কুণ্ঠার পরিবর্তে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করিতেছিল-যখন নগরীকুলসম্রাজ্ঞী বিপুল বীর্য ও ঐশ্বর্যশালিনী দিল্লীর তখতে অধ্যবসায়ের অবতার প্রথিত-যথা আকবরশাহ্ উপবেশন করিয়া স্বকীয় প্রভাব বিস্তার করিতেছিলেন-যখন বীরপুরুষ দায়ুদ খাঁ, সুজলা-সুফলা হিন্দুস্তানের রম্য-উদ্যান বঙ্গভূমির রাজধানী দিল্লীর গৌরব-স্পর্ধিনী গৌড় নগরীতে রাজত্ব করিতেছিলেন-সেই সময়ে একদিন বৈশাখ মাসের কৃষ্ণা দশমীতে রাত্রি দেড় প্রহরের সময় শ্রীপুর ও খিজিরপুরের মধ্যবর্তী রাস্তার এক চটিতে কতকগুলি রক্ষীসহ একখানি পাল্কী আসিয়া উপস্থিত হইল।
পাল্কীখানা বিবিধ কারুকার্যে অতি চমৎকাররূপে সজ্জিত। পাল্কীর উপরে ঝালরযুক্ত জরীর চাদর শোভা পাইতেছে। পাল্কীর সঙ্গে দুইজন মশালচী। তাহাদের হস্তস্থিত প্রকান্ড মশাল কৃষ্ণা দশমীর অন্দকাররাশি অপসারিত এবং সেই বৃক্ষ-সমাকীর্ণ চটির বহুস্থান আলোকিত করিয়া শাঁ শাঁ করিয়া জ্বলিতেছিল। বারজন রক্ষী, আটজন বেহারা এবং তদ্ব্যতীত তিনজন ভারী ও একজন সম্ভ্রান্ত যুবক পাল্কীর সঙ্গে ছিল। রক্ষী বারজনের মধ্যে তিনজনের হস্তে বন্দুক, পাঁচজনের হস্তে রামদা এবং চারিজনের হস্তে তেল-চুকচুককে রূপা দিয়া গাঁট-বাঁধা বাঁশের পাকা লাঠি। সকলেই পদাতি; কেবল সম্ভ্রান্ত যুবকটি একটি বলিষ্ঠ অশ্বের আরোহী। যুবকের গায়ে পিরহান, পরিধানে ধুতি, মস্তকে একটি জরীর টুপি, কটীতে চাদরের দৃঢ় বেষ্টনী, পায়ে দিল্লীর সুন্দর নাগরা জুতা। যুবকের কটীতে একখানি কোষবদ্ধ ক্ষুদ্র তরবারি দুলিতেছিল। যুবকের বয়স অন্যূন বিংশতি বর্ষ। চেহারা বেশ কমনীয় ও পুষ্ট; গঠন দোহারা; অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেরূপ মাংসল সেরূপ পেশীযুক্ত নহে। যুবক যে সম্ভ্রান্ত বংশের, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই।
বেহারারা চটির একটি প্রকান্ড শাখা-প্রশাখাশালী ঘন পত্রযুক্ত বটবৃক্ষের মূলে পাল্কী নামাইয়া কাঁধের গামছা দিয়া দুই চারিবার হাওয়া খাইয়া গাছের নিকটেই ঘুরিতে লাগিল। যুবকটি ঘোড়া হইতে নামিয়া একটি রক্ষীর কোমরে আবদ্ধ ক্ষুদ্র বিড়িদান হইতে পান লইয়া চিবাইতে চিবাইতে পায়চারী করিতে লাগিল। একজন রক্ষী একটি আমগাছের চারার সহিত ঘোড়াটিকে আটকাইয়া রাখিল। ভারীরা ভার নামাইয়া ঘাম মুছিতে লাগিল। তারপর তামাক সাজিয়া সকলেই তামাক খাইতে লাগিল। একটি রক্ষী ভার হইতে একটি ভাল কাল-মিশ্মিশে নারিকেলী হুঁকা বাহির করিয়া একটু ভাল তামাক যুবককে সাজিয়া দিল। যুবক দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া হুঁকা দেবীর মুখ চুম্বন করিতে এবং মধ্যে মধ্যে কুণ্ডলীকৃত ধূমরাশি ছাড়িতে লাগিলেন। মুহুর্তে মধ্যে বটগাছের তলা হুক্কার সুমধুর গুড়্ গুড়্ ধ্বনিতে ও কুণ্ডলীকৃত ধূমে সজাগ স্ফূর্ত ও মূর্ত হইয়া উঠিল।