দস্যুগণ চলিয়া যাইবার পরে যাহারা জীবিত এবং সচেতন ছিল, তাহারা মশাল জ্বালাইয়া সকলের অনুসনন্ধান করিতে লাগিল। সকলকেই মৃত বা জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেল। কিন্তু হায়! ফিরোজা বেগমের কোনই সন্ধান হইল না। তাঁহাকে পাল্কীরবাহকেরা বলিল যে, দস্যুরা তাহাকে পাল্কীসহ বহনকরিয়া লইয়া গিয়াছে। অল্প সময় মধ্যেই এ সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত হইয়া পড়িল। দিল্লী এবং রোহিলাখণ্ডে হাহাকার পড়িয়া গেল। নজীব- উদ্দৌলা পৃথিবী অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন! হিন্দুস্থানের মুসলমানদিগের মধ্যে ভীষণ আতঙ্ক ও উত্তেজনার সঞ্চার হইল।
ফিরোজা বেগম তৎকালে সৌন্দর্যের জন্য সর্বত্রই বিখ্যাত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি যেমন রূপবতী, তেমনি বিদূষী ছিলেন। পারস্য ভাষায় তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাকে সকলেই ‘মুনশী ফাজেলা‘ বলিয়া অভিহিত করিতেন। শাহ আলম তাঁহাকে নিজের কণ্যার মত ভালোবাসিতেন। তাঁহার মধুর চরিত্র, নিমৃল রুপ, অপুর্ব গঠনভঙ্গিমা, প্রগাঢ় ধর্মভাব এবং তাঁহার সরস কবিতা পাঠে দিল্লীর সকলেই মুগ্ধ ছিলেন।
চতুর্দিক ফিরোজা বিগমের অনুসন্ধান হইতে লাগিল। অনেকেই সিদ্ধান্ত করিল যে, এই লূণ্ঠন ও হরণ ব্যাপারটা মারাঠীদিগের দ্বারাই সম্পাদিত হইয়াভে। কিন্তু সকলেই বলিলেন যে আক্রমণকারীরা জাঠ ছিল। সদাশিব রাও যে কয়েকটি দস্যুকে দন্দী করিয়াছিল, তাহারা জাঠ ছিল। তাহাদিগকে মুক্তি দিবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তাহারা প্রকাশ করিল যে, ভরতপুরের রাজাই এই লুণ্ঠনের কারণ। তাঁহার আদেশেই তাঁহার সৈনিকেরা রাতহানা দিয়া অতর্কিত অবস্থায় ফিরোজা বেগমই লুঠিয়া লইয়াছে।
ইতিপূর্বে যখন মারাঠীরা ভরতপুর আক্রমণ করিয়াছিল, তখন ভরতপুরের রাজা ছত্রসিংহ রোহিলাদিগের নিকট এবং বাদশাহ শাহ আলমের নিকট সাহায্য করিয়াছিলেন না সেই রাগেই ছত্রসিংহ রোহিলাদিগকে জব্দ করিবার জন্য ফিরোজা বেগমকে হরণ করিয়া লইয়াছে। সদাশিব রাও বিশেষ সহানুভূতি দেখাইয়া বলিলেন, ইহা নিশ্চয়ই জাঠদিগের কার্য। মারাঠীরা কখনও রোহিলা সর্দারের পুত্রবধূ হরণ করিবেন না। মারাঠীদিগের কোনও দলই সেদিন কোথাও লুণ্ঠনে বহির্গত হয় নাই।
সফদরজঙ্গ, নজীব- উদ্দৌলা এবং বাদশাহ স্বয়ং নানা স্থানে সুদ সন্ধানীদিগকে প্রেরণ করিলেন। কিন্তুকোথায়ও কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। ভরতপুরেও অনেক গুপ্তচর পাঠান হইল। কিন্তু হায়! কেহই কোনও খবর আনিতে পারিল না। ভরতপুররাজ লোকমুখে এবং জনশ্রুতি- পরস্পরা হাঁহার সন্বন্ধে ফিরোজা বেগমের হরণের কলঙ্কারোপ শুনিয়া দিল্লীশ্বরকে এক পত্র লিখিলেন।
[[ পত্র ]]
মহামহিমান্বিত দিল্লীশ্বর!
সহস্র সহস্র সালাম এবং কুর্ণিশ পর কৃতাজ্ঞলিপুটে বিনীত নিবেদন এই যে, অকারণে আমার প্রতি ফিরোজা বেগমের হরণের কথা বিশ্বাস করিতেছেন। আমার শক্ররাই এই অলীক কলঙ্ককালিমা আমার মস্তকে নিক্ষেপ করিবার চেষ্টা করিতেছে। এ অধীন দ্বারা এমন পাপকার্য কদাপি অনুষ্ঠিত হইতে পারে না। আমি এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত অবগত নহি। অধুনা লোকমুখে শুনিতে পাইয়া মর্মান্তিক কেশ ভোগা করিতেছি। দাসকে আর বৃথা সন্দেহ করিবেন না। দাস এখনও দিল্লীপতিকেই ভরতপতি বলিয়াই মনে করে পত্রের অপরাধ মার্জনা করিতে মর্জি হয়।
শাহানশাহের কৃপাভিখারী
ছত্রসিংহ
ভরতপুর।
এই পত্র পাইয়া নজীব- উদ্দৌলা এবং শাহ্ আলম বলিলেন, ”ইহা কদাপি ভরতপুরের কার্য নহে। ছত্রসিংহ চরিত্রবান এবং ধার্মিক। ইহা নিশ্চয়ই কোনও না কোনও মারাহীদলেরই কার্য। তাহারা ব্যতীত এমন কার্য কাহারও দ্বারা সম্ভব না।
কিন্তু সদাশিব রাও বলিলেন, ”ইহা নিশ্চয়ই জাঠদিগের কার্য। তাহা না হইলে” মাচার উপরে কে রে? তার উত্তর আমি কলা খাই না। এরূপ ঘটনা ঘটিবার কোনও কারণ নাই। ভরতপুরপতি ছত্রসিংহ গায়ে পড়িয়া নিজেই নিজের দোষ ক্ষালন করিয়াছেন। আমরা ত তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি নাই যে, তিনি পত্র লিখিয়া নিজের সাফাই গাহিবেন। অযাচিতভাবে এই পত্র লেখাতেই তাঁহার অপরাধ প্রতিপন্ন হইতেছে।”
অতঃপর সফদরজঙ্গ এবং বাদশাহের প্রেরিত কয়েকজন গুপ্ত-সন্ধানীকে অর্থ দ্বারা বশীভূত করিয়া, সদাশিব রাও সন্ধান দেওয়াইলেন যে, ফিরোজা বেগম ভরতপুর-প্রাসাদেই আছে। এইরূপ ষড়যন্ত্রের ফলে বাদশাহ্ এবং সফদরজঙ্গ ক্রমশঃ বিশ্বাস করিলেন যে, ইহা ভরতপুর-রাজেরই কার্য। কিন্তু নজীব-উদ্দৌলা কিছুতেই তাহা বিশ্বাস করিলেন না। তবে কঠোরভাবে প্রতিবাদও করিলেন না।
পরামর্শ ঠিক হইল যে, ভরতপুর আক্রমণ করিয়া ফিরোজাকে উদ্ধার করিতে এবং ছত্রসিংহকে কঠোর শাস্তি প্রদান করিতে হইবে সদাশিব রাও সর্বপ্রকারে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। সুতরাং ভরতপুর আক্রমণে ”সাজ সাজ” রব পড়িয়া গেল।
ফিরোজা বেগম ০৫ পরিচ্ছেদ
সেতারার সুসজ্জিত একটি প্রাসাদে ফিরোজা বেগমের বাসের বন্দোবস্ত হইয়াছে। ফিরোজা বেগমের নাম লক্ষ্মীবাঈ রাখা হইয়াছে। তাহার সেবার জন্য বন্দোনস্ত হইয়াছে। দাসদাসীর বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। সুখ-সুবিধার জন্য কোনও ক্রটি নাই। কিন্তু হায়! বন্দীর মনে আবার সুখ কবে? স্বাধীন বনবিহারী বিহঙ্গকে বহু যত্নে সুবর্ণ পিঞ্জরে আবদ্ধ রাখিলেন এবং পৃথিবীর নানা দেশের সুরসাল ও সুললিত ফলমূল দান করিলেও, তাহার প্রানে অশান্তি এবং আত্মগ্লানি কখনও বিন্দুমাত্রও দূর হয় না।