সদাঃ তার সঙ্গে ত আমাদের সন্ধি আছে। সুতারং ফিরোজা বানুকে হরণ করলে বা ছিনিয়ে নিলে, তার সহিত যুদ্ধ অনিবার্য।
ভাস্করঃ আমরাও ত চাই চাই। সন্ধিতে আমাদের ক্ষতি। সন্ধি আছে আছে বলেই ত রোহিলাদিগের ধনসম্পত্তিও লুণ্ঠন করতে পাচ্ছি না।
সদাঃ কিন্তু রোহিলাদিগকে ঘাঁটান আর ভীমরুরের চাকে আঘাত করা সমান কথা। রোহিলাদিগকে ঘাঁটালে আমাদিগকে বিষম বেগ পেতে হয়।
ভাস্করঃ তেমন কিছু নয়, মহারাজ। রোহিলারা মহাতেজী এবং বীরপুরুষ বটে; সম্মুখযুদ্ধে তারা চির জয়শীল। কিন্তু আমরা ত আর যুদ্ধ করব না। গভীর অন্ধকারে হঠাৎ তাদের উপর আপতিত হয়ে তাদিগকে বিপর্যস্ত করে ফেলব। আর আসল কথা হচ্ছে, আমরা রোহিলাখণ্ডে না গেলে, তারাই বা কেমন করে এখানে এসে আক্রমণ করেব?
সদাঃ রমণী হরণ করলে, মুসলমান তার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না। সে প্রতিশোধে যতই প্রাণ বলি দিতে হোক না কেন, মুসলমান কখনই তা’তে কুণ্ঠিত হবে না। এমন কি, সমস্ত ভারতেও এই অগ্নি প্রোজ্জ্বলিত হতে পারে। রমনীর ইজ্জতকে ওরা নিজের প্রাণ হতেও সহস্র গুণে শ্রেয়ঃ বোধ করে।
ভাস্করঃ এত আশঙ্কা করলে এ ভোগে লালসা না করাই সঙ্গত। কি প্রয়োজন? মারাঠীদিগের মধ্যে না হয়, হিন্দুস্থানী ব্রহ্মণদিগের মধ্য হতে শত শত সুন্দরী বিনা কেশে বিনা ঝঞ্ঝাটে সংগৃহীত হতে পারে।
সদাঃ অমৃতের পিপসা কি জলে মিটে? ফিরোজাকে না পেলে ত জীবনই বৃথা। ফিরোজার ন্যায় সুন্দীর গুণবতী আর কে?
ভাস্করঃ মহারাজ! গুড়, মধু, চিনি, মিশ্রী সবই মিষ্টি।
সদাঃ মিষ্ট ত সবই বটে! কিন্তু তাই বলে গুড় ও মধুর মিষ্টতা ত এক নয়।
ভাস্করঃ এক ত নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মধু খেতে গেলেই মৌমাছির হুলও খেতে হবে।
সদাঃ সেইটা যা’তে খেতে না হয়, অথচ মধুর চাক ভাঙ্গা যায়, এইরূপ বন্দোবস্ত করাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কার্য।
ভাস্করঃ সেই বুদ্ধি খাটাবার জনইত এত মাথাব্যথা।
সদাঃ মাথাব্যথা ত বটে, কিন্তু জিজ্ঞেস করি, মাথামুণ্ডু করলে কি?
ভাস্করঃ নিশ্চিন্ত হউন। সে ফন্দি এঁটেই বসে আছি।
সদাঃ ফন্দিটা একবার শুনিই না কেন?
ভাস্করঃ ফন্টিা হচ্ছে এই যে, আপনি সেদিন নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য নজীব-উদ্দৌলার বরযাত্রীর এবং বন্ধু ও হিতৈষীরূপে বিবাহে উপস্থিত থেকে আপনার হিতৈষণা এবং সৌজন্য প্রদর্শন করবেন। আমরা জাঠদিগের ছদ্মবেশে ফিরোজাকে হরণ করে নিব। এ জন্য আমি একদল জাঠ দস্যুরও বন্দোবস্ত করেছি। আপনি বরং আপনার মারাঠী দেহরক্ষী সেনা নিয়ে আমাদিগকে বাধা দিবেন। দুই একটা জাঠকে কৌশলে গ্রেফ্তারও করে নিব। তাদিগকে পূর্ব হ’তেই মন্ত্র পড়ায় কারসাজী বলে ব্যক্ত করবে।
সদাঃ বাহবা ভাস্কর! বাহবা তোমার বুদ্ধি! তুমি যে শুধু সেনাপতি নও, পণ্ডিতও, তা’যথার্থই বটে! এক ঢিলে দুই পাখী শিকার!
ভাস্করঃ মহারাজ! রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই হবে। এই ব্যাপারে ভরতপুরের মহারাজের সঙ্গে সফদরজঙ্গের এবং তৎসঙ্গে নজীব-উদ্দৌলার স্বয়ং বাদশাহের পর্যন্ত বিরোধ লেগে যাবে। ভরতপুরের আমাদের যেরূপ বিরুদ্ধে আচরণ করছে, তাতে এই রূপ উপয়েই তাকে জব্দ করতে হয়। রোহিলার খড়গেই তার বলি হবে।
সদাঃ কেন? আমরাও ত সফদরজঙ্গ এবং নজীব-উদ্দৌলার সঙ্গে যোগ দিয়েই ভরতপুর লুন্ঠন করবো। তাতে রোহিলাদের সঙ্গে আমাদের আরও সদ্ভাব বেড়ে যাবে।
ভাস্করঃ তা’কি আর বলতে হবে? ধন্য তোমার উদ্ভাবনী শক্তি। যাও, এখন কাজে যাও। কার্যসিদ্ধির পরে আশাতীত খেলাত!
ফিরোজা বেগম ০২ পরিচ্ছেদ
দিল্লীর হেরেমের নিভৃত করে বাদশাহ্ শাহ্ আলম, শেখুল-ইসলাম মওলানা আমিনার রহমান, উজীর সফদরজঙ্গ, মালবের শাসনকর্তা আফ্তাব আহ্মদ খান এবং মোসাহেব মালেক আনোয়ার উপস্থিত। বাদশাহ্ একখানি সোফায় উপবিষ্ট, আর সকলেই দ্বিরদ-রদ-নির্মিত পুরু গদিবিশিষ্ট কুর্সীতে সমাসীন।
এইটি অন্তঃপুরের সম্মিলন কক্ষ। একটি ১০১ ডালের স্বর্ণখচিত ঝাড়ে কর্পূরমিশ্রিত মোমবাতি জ্বলিয়া জ্বলিয়া শুভ্র ও সুগন্ধি আলোক বিকীর্ণ করিতেছে। দেওয়ালে দুগ্ধফেননিভ শ্বেত মর্মরের উপরের সুবর্ণের নানাবিধ চিত্র ও নক্শা অঙ্কিত। সে কারুকার্য একদিকে যেমন সূক্ষ্ম কৌশলের অভিব্যক্তি, অন্যদিকে তেমনই গঠনপারিপাট্যের চরম গৌরবের পরিচায়ক! মধ্যখানে একটি হস্তিদন্ত এবং আবলুস কাষ্ঠনিনির্মত মেজ। সে মেজের উপরে সমস্ত পৃথিবীর বিস্তৃত চিত্র সুবর্ণে অঙ্কিত। মেজের একপার্শ্বের কতকগুলি সচিত্র গ্রন্থ। দক্ষিণর দেওয়ালে জগদ্বিজয়ী বীরকুলের গৌরবকেতন মহাতেজী তাইমুরের আশ্বারোহী কৃপাণ-পাণি মূর্তি! তাইমুরের চক্ষু হইতে প্রভাত-তারকার ন্যায় বিশ্ববিজয়িনী প্রভা নির্গত হইতেছে। মুখমণ্ডলে প্রখর বীর্যভাতির সঙ্গে নিবিড় গাম্বীর্য! হঠাৎ দেখিলে চিত্রখানিকা সজীব বলিয়া বোধ হয়।
তাইমুরের সম্মুখে চীন, মঙ্গোলিয়া, মাঞ্চুরিয়া, রুশিয়া, পারস্য, ভারতবর্ষ, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, জর্জিয়া, ক্রিমিয়া, আষ্টোকান, নরওয়ে সুইডেন, ডেনমার্ক তিব্বত, নেপাল, ভোটান এবং খোরসান প্রভৃতি দেশের সোলাতান, সম্রাট, আমীর, মহারাজা এবং রাজগণ উপঢৌকন হস্তে দণ্ডায়মান। তাইমুরের অশ্বের পদতলস্থ নাল হইতে প্রস্তরাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছে। ছবিখানি দেখিলেই কাপুরুষের ভীতি এবং বীরপুরুষের মনে আনন্দ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। আওরঙ্গজেব এই ছবির চিত্রকর চীনকিচ খানকে সস্তুষ্ট হইয়া লক্ষ টাকা দান করিয়াছিলেন। এই চিত্রের পার্শ্বেই তাইমুরের জ্ঞানপিপাসু বিদ্যানুরাগিণী প্রাতঃস্মরনীয়া বেগম-বিবি খানমের প্রশান্ত মুর্তি! মরি মরি! কি শোভনীয় এবং শ্রদ্ধা-আকর্ষিণী মূর্তি! বেগম বালারুণ-কিরণ-রাগ-রঞ্জিত গগনতলে একটি পর্বর্তের ক্ষুদ্র শৃঙ্গের শ্যামল সানুদেশে সমাসীনা।