সদাশিবঃ ওরে বাপরে! তবেই ত গেছি। মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া! এমন অধর্ম কখন করবেন না।
তুলাজীঃ ও সব কথার প্রয়োজন নাই। এখন এ যুদ্ধে আপনি স্বয়ং যাবেন, কি পণ্ডিতবরকে পাঠাবেন, তাই নির্ধারন করে সৈন্যদলকে সজ্জিত হবার আদেশ প্রদান করুন।
সদাশিবঃ নজীব-উদ্দৌলার ত খোঁজ খবর নাই। মাত্র দু’হাজার রোহিলা সৈন্যকে সর্দার আহমদ খান পাঠিয়েছেন।
তুলাজীঃ নজীব-উদ্দৌলা নাকি স্ত্রীর শোকে নিতান্ত উন্মাদ হয়ে পড়েছেন।
সদাশিবঃ বেশ কথা, বড় ভুল হয়ে গেছে। তাকে সে রাত্রে সাবাড় করে ফেলাই উচিত ছিল।
তুলাজীঃ সফদরজঙ্গ যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে ফিরোজা বেগম ভরতপুরেই আছেন।
সদাশিবঃ যথা লাভ। সফদরজঙ্গ ভালো যোদ্ধা। দিল্লীর সেনাপতি শমশেরজঙ্গও ব্যুহ রচনায় বেশ পণ্ডিত। তা’হলে আপনি কাল সকালে ভরতপুরে কুচ করবার জন্য প্রস্তুত হোন। ভাস্করজী আমার পরিবর্তে দিল্লী থাকবেন। আমি দু’চার দিনের মধ্যেই সেতারায় রওয়ানা হব।
ফিরোজা বেগম ০৭ পরিচ্ছেদ
বেগমকে লইয়া মুরলা দ্রুতপদে অক্রবক্র রাস্তা অবলম্বন করিয়া একটি পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিল। এই পল্লীতে একটি প্রাচীন শিব-মন্দির ছিল। শিব-মন্দিরের চতুর্দিকে নানাজাতীয় বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষাদি থাকায় স্থানটি অন্ধকারপূর্ণ ছিল। রাত্রিতে ভয়ে এ মন্দিরে কেহই প্রবেশ করিত না। মুরলা এবং ফিরোজা দুইজনে মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া প্রদীপ জ্বালাইল। প্রদীপ জ্বালাইয়া দুইজনে পরামর্শ করিতে লাগিল যে, কিরূপ বেশে সেতারা হইতে বাহির হওয়া আবশ্যক।
ফিরোজা বলিলেন, “আমরা উভয়েই যুবতী। সুতরাং নারীবেশে দূর দূরান্তরে গমন করা অসঙ্গত।”
মুরলাঃ ঠিকই বলেছেন। নারীবেশে বের হলেই আবার বিপদে পড়তে হবে। আপনার কমনীয় কান্তি, রমনীয় শ্রী এবং ললিত লাবণ্য যে দেখবে সেই বিমোহিত হবে। আপনি যে মারাঠি মহিলা নন, তা’ স্পষ্টতই ধরা পড়বে। অন্যদিকে পুরুষ বেশেও মহাবিপদের সম্ভাবনা। এ জন্য আমি মনে করি, আমরা দু’জনেই সন্ন্যাসিনী বেশে বহিগর্ত হ’লে আর বিপদের আশঙ্কা থাকে না। আমি তার বন্দোবস্ত করে রেখেছি। আমরা মারাঠি রাজ্য ত্যাগ করে নিজাম-রাজ্যে পৌঁছলে সেখানে আপনি রাজ সরকারেও অনেক সাহায্য পেতে পারবেন। অথবা তথা হতে দিল্লী বা রোহিলাখণ্ডে সংবাদ প্রেরণও বেশী কিছু কঠিন হবে না। আপনি ত বলেছেন যে, নিজাম-দরবারে আপনার উচ্চ পদস্থ আত্মীয় আছেন।
ফিরোজাঃ আমি ত সন্ন্যাসিনীর আচার-ব্যবহার কিছুই জানি না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বা কি বলব?
মুরলাঃ আপনি নিশ্চিত থাকুন। আমি ঠিক করে দিব। সন্ন্যাসিনীর নামধাম, ধর্মমত কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। এরূপ জিজ্ঞেস করা নিয়মবিরুদ্ধ। জিজ্ঞেস করলেও নিরুত্তর থাকবেন। তা’তে কেউই দোষ ধরবে না।
ফিরোজাঃ সঙ্গে অস্ত্র থাকা আবশ্যক।
মুরলাঃ একটি একটি করে আমাদের দু’টি ত্রিশূল ত থাকবেই।
ফিরোজাঃ তরবারি হলেই ভালো হয়। আমি তরবারি ভালো চালাতে জানি।
মুলাঃ তরবারি থাকলে লোকে সন্দেহ করবে। আমরা যে যথার্থ সন্ন্যাসিনী নই, তাই বুঝাবে। লোকের সন্দেহের উদ্রেক হবে।
ফিরোজাঃ তা’ হলে তরবারির আর প্রয়োজন নাই।
অতঃপর মুরলা বেগমকে ভৈরবী সাজাইতে আরম্ভ করিল। গিরিমাটি ঘষিয়া চুলগুলির তৈলাক্ত ভাব দূর করিয়া ললাটোপরি শিব-চূড়া বাঁধিয়া ধিল। বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া রক্তবর্ণ চেলী পরাইয়া দিল। হস্তে এবং গলে রুদ্রাক্ষের মালা, ললাটে রক্তচন্দ্রনের ত্রিপুণ্ড্রক।
ফিরোজার বর্ণ কিছু মলিন করিবার জন্য প্রথমে মুখে কিছু ছাই মাখিয়া পরে গৈরিক আমর্শন করিয়া দিল। এইরূপভাবে পিরোজাকে সাজাইয়া দর্পণে মুখ দেখিতে বলিল। ফিরোজা আপনার মূর্তি দেখিয়া আনন্দে স্মিতহাস্য করিলেন।
মুরলা বলিল “এবার এ ভৈরবীর রূপ দেখলে তেত্রিশ কোটি দেবতা স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে এসে শ্রীচরণতলে গড়াগড়ি দিবে। দেবাদিদেব মহাদেব ভৈরব পর্যন্ত ত্রিলোকমোহিনী চির উদ্বিন্নযৌবনা কমলাননা পার্বতীকে পর্বতে ত্যাগ করে তোমার নীলোৎপলনিন্দিত নয়নের সন্মোহন বাণে বিদ্ধ হয়ে ঐ লোলিতাব্জ-সঙ্কাশ প্রেমিকজন-শরণ চরণতলে লুণ্ঠিত হবেন।”
মুরলার কথা শুনিয়া ফিরোজা স্মিতহাস্য করিয়া বলিলেন, “এখন রঙ্গরস রাখ। পলায়নের উপায় দেখ। নিজে শীঘ্র সজ্জিত হও।”
“আমার শহরের বাইরে বের হয়ে পড়েছি। সুতরাং রাত্রিতে রওয়ানা হলে আর কোন আশঙ্কা নাই।” – এই বলিয়া মুরলা নিজেও ভৈরবীর বেশে সত্বর সজ্জিত হইয়া ফিরোজার হস্তে একখানি ত্রিশূল ও তাঁহার স্কন্ধে গৈরিক একটি ঝুলি ঝুলাইয়া দিয়া তদনুরূপ নিজেও ত্রিশূল এবং ঝুলি ধারণ করতঃ নির্গত হইয়া পড়িল।
সমস্ত রাত্রি গমনের পরে প্রভাতে তাঁহারা ত্র্যন্বকনাথ নামক গ্রামে “বাবা একলিঙ্গের” মন্দিরে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। ভৈরবীযুগলকে দেখিয়া মন্দিরের সেবাইতরা পরম যত্নে আহারের বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। উভয় ভৈরবীর একত্র সম্মিলন এবং তন্মধ্যে একজনের বিস্ময়কর রমনীয় কান্তি ও তেজস্বিনী প্রকৃতি দেখিয়া সকলেই ভয়, বিষ্ময় এবং ভক্তিতে গড় করিতে লাগিল।
সমস্ত দিন বিশ্রাম করিয়া অপরাহ্নে আবার দুইজনে পথাতিক্রমে বাহির হইয়া পড়িলেন। আমাদের ভৈরবীযুগল যে পথ দিয়া যাইতে লাগিলেন, সেই পথের দুইপাশে বহু নরনারীর ভীড় হইতে লাগিল। অনেকেই বলিল, “স্বয়ং মা পার্বতী ভৈরবী মূর্তি ধারণ করে সখীসহ দাক্ষিণাত্য-ভ্রমণে বের হয়েছেন।”