বুঝেছি।
পুরীর বিখ্যাত রথ দেখে মন্দিরের সামনে বিশাল চওড়া রাস্তার একপাশে দোকানগুলোয় ঘুরে ঘুরে পাথরের তৈরি খুদে খুদে মূর্তি, কোনারকের চাকা, এইসব দেখছি, এমন সময় সাব-ইনস্পেক্টর মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্রের আবির্ভাব। হঠাৎ চিনতে পারিনি, কারণ এই ফাঁকে কখন জানি চুল ছেটে এসেছেন। আমাদের এক দূর সম্পর্কের কাকা আছেন, যিনি হেয়ার কাটিং সেলুনে চেয়ারে বসলেই ঘুমিয়ে পড়েন; ফলে নাপিত বেহিসাবি কিছু করলে টের পান না। ঘুম ভাঙার পর অবিশ্যি প্রতিবারই কুরুক্ষেত্ৰ বেধে যায়। মহাপাত্ৰকে দেখে মনে হল এনারিও সে বাতিক আছে।
ফেলুদা ভদ্রলোককে দেখে জিজ্ঞেস করল, তদন্ত এগোল? মেহেরালি রোডের মিস্টার সরকার কী বলেন?
ইনফরমেশন এসেছে আজি আড়াইটেয় বললেন মহাপাত্ৰ।চোদ্দো নম্বর মেহেরালি রোড হল একটা ফ্ল্যাট বাড়ি! সবসুদ্ধ আটটা ফ্ল্যাট, সরকার থাকেন তিন নম্বরে। দিন সাতেক হল ওঁর ঘর তালাবন্ধ। প্রায়ই নাকি বাইরে যান।
এবার কোথায় গেছেন জানতে পারলেন?
পুরী।
বটে? কে বলল?
চার নম্বরের বাসিন্দা। তাকে নাকি বলেছে চেঞ্জে যাচ্ছে।
চেহারা কেমন জানতে পারলেন?
লম্বা, মাঝারি রং, দাড়ি-গোঁফ নেই, বয়স পঁয়ত্ৰিশ থেকে চল্লিশ। এ ধরনের বর্ণনার অবিশ্যি কোনও মূল্য নেই।
পেশা?
বলে ট্র্যাভেলিং সেলসম্যান। কী সেল করে তা কেউ জানে না। বছর খানেক হল ওই ফ্ল্যাটে এসেছে।
আর রূপচাঁদ সিং?
সে এখানে এসেছে গতকাল সকালে। বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা হোটেলে ছিল। ভাড়া চুকোয়নি। কাল রাত্রে নাকি একটা ফোন করতে চেয়েছিল হোটেল থেকে, ফোন খারাপ ছিল। শেষে একটা ডাক্তারি দাকান থেকে কাজ সারে। কম্পাউন্ডার পাশেই দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু খদ্দের ছিল বলে কী কথা হয়েছে তা শোনেনি! এগারোটা নাগাদ হোটেল থেকে বেরোয়। আর ফেরেনি। ঘরে একটা সুটকেস পাওয়া গেছে, তাতে জামা-কাপড় রয়েছে কিছু। দুটো টেরিলিনের শার্ট দেখে মনে হয় লোকটা বেশ শৌখিন ছিল।
সেটা কিছুই আশ্চর্য না, বলল ফেলুদা, আজকাল ড্রাইভারের মাইনে আপিসের কেরানির চেয়ে অনেক বেশি।
কথাই ছিল রেলওয়ে হোটেল থেকে বিলাসবাবুকে আমরা তুলে নেব; ছটা বাজতে পনেরো মিনিটে আমরা হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। ব্রিটিশ আমলের হোটেল, এখন রং ফেরানো হলেও চেহারায় পুরনো যুগের ছাপটা রয়ে গেছে। সামনে বাগান, সেখানে রঙিন ছাতার তলায় বেতের চেয়ারে বসে হোটেলের বাসিন্দারা চা খাচ্ছে। তারই একটা থেকে উঠে পাশের চেয়ারে বসা দুজন সাহেবকে এক্সকিউজ মি বলে বিলাসবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
চলুন, কপালে কী আছে দেখা যাক?
আজ লালমোহনবাবু আমাদের গাইড, তাই তাঁর হাবভাব একেবারে পালটে গেছে। দিব্যি গটগটিয়ে সাগরিকার গেট দিয়ে ঢুকে বাগানের মধ্যিখানের নুড়ি ফেলা পথ দিয়ে সটান গিয়ে বারান্দায় উঠে কাউকে না দেখে একটু থতমত খেয়ে তৎক্ষণাৎ আবার নিজেকে সামলে নিয়ে সাহেবি মেজাজে কোই হ্যায় বলতেই বাঁ দিকে একটা দরজা খুলে গেল।
স্বাগতম!
বুঝলাম ইনিই লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। পরনে সিঙ্কের লুঙ্গি আর চিকনের কাজ করা সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। মাঝারি হাইটের চেহারার বিশেষত্ব হল সরু গোঁফটা, যেটা ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে প্ৰায় আধা ইঞ্চি নেমে এসেছে নীচের দিকে।
লালমোহনবাবু আলাপ করাতে যাচ্ছিলেন, ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, ওটা ভিতরে গিয়ে হবে। আসুন।
লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের বৈঠকখানার বেশির ভাগটা দখল করে আছে একটা তক্তপোশ; বুঝলাম ওটার উপরে বসেই ভাগ্যগণনা হয়। এ ছাড়া আছে দুটো কাঠের চেয়ার, একটা মোড়া, একটা নিচু টেবিলের উপর ওড়িশা হ্যাঁন্ডিক্রাফটসের একটা অ্যাশট্রে, আর পিছনে একটা দেয়ালের আলমারিতে দুটো কাঠের বাক্স, কিছু বই, কিছু শিশি-বোতল-বয়াম ইত্যাদি ওষুধ রাখার পাত্র, আর একটা ওয়েস্ট এন্ড অ্যালার্ম ঘড়ি।
আপনি বসুন। এইখেনটায়—তক্তপোশের একটা অংশ দেখিয়ে বিলাসবাবুকে বললেন গণৎকার। —আর আপনারা এইখেনে।
চেয়ার আর মোড়া দখল হয়ে গেল।
লালমোহনবাবু এইবারে আমাদের সঙ্গে আলাপটা করিয়ে দিলেন। ফেলুদার বিষয় বললেন, ইনিই আমার সেই বন্ধু, আর বিলাস মজুমদারের নামটা বলে ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত ওয়াই–বলেই জিভ কেটে চুপ করে গেলেন। আমি জানি উনি বলতে গিয়েছিলেন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটাগ্রাফার; নিজের বুদ্ধিতেই যে নিজেকে সামলে নিয়েছেন সেটা আশ্চর্য বলতে হবে।
ফেলুদা বোধহয় কেলেঙ্কারিটা চাপা দেবার জন্যই বলল, আমরা দুজন অতিরিক্ত লোক এসে পড়েছি বলে আশা করি আপনি বিরক্ত হননি।
মোটেই না বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। —আমার আপত্তি যেটাতে সেটা হচ্ছে স্টেজে উঠে ডিমনষ্ট্রেশন দেওয়ায়। সে অনুরোধ অনেকেই করেছে। আমি যে যাদুকর নই সেটা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। এই যেমন-
ভদ্রলোকের কথা থেমে গেল। তাঁর দৃষ্টি চলে গেছে বিলাস মজুমদারের দিকে। —কী আশ্চর্য! বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচাৰ্য্য—আপনার কপালে ঠিক থার্ড আই-এর জায়গায় দেখছি একটি উপমাংস!
উপমাংস মানে যে আঁচিল সেটা জানতাম না।
ঠিক ওইখানে খুলির আবরণের তলায় কী থাকে জানেন তো? ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করলেন।
পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের কথা বলছেন? ফেলুদা বলল।
হ্যাঁ—পিনিয়াল গ্ল্যান্ড। মানুষের মগজের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ। অন্তত পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকরা তাই বলেন। আমরা যদিও জানি যে ওটা আসলে প্রমাণ করে যে আদিম যুগে প্রাণীদের তিনটি করে চোখ ছিল, দুটি নয়। ওই থার্ড আইটাই এখন হয়ে গেছে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড। নিউগিনিতে একরকম সরীসৃপ আছে, নাম টারটুয়া, যার মধ্যে এখনও এই থার্ড আই দেখতে পাওয়া যায়।