মাঝে মাঝে করি, বললেন বিলাস মজুমদার, কারণ বালিতে হাঁটতে কষ্ট হয়। কিন্তু উনচল্লিশ বছর বয়সে হাতে লাঠি ধরতে ইচ্ছে করে না।
তা হলে অন্য কেউ হবে।
অবিশ্যি শিন বান ভাঙাই একমাত্র ইনজুরি নয়। পাহাড়ের গা দিয়ে পাঁচশো ফুট গড়িয়ে পড়েছিলাম। একটা গাছের উপর পাড়ি তাই জখমটা তৰু কম হয়। এক চাষার ছেলে কয়েকজন হিপিকে খবর দেয়, তারাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শিন বোন ছাড়া সাতটা পাঁজরার হাড় আর কলার বোন ভেঙেছিল। থুতনি থেতলে গিয়েছিল; দাড়ি রেখেছি ক্ষতচিহ্ন ঢাকবার জন্য। দুদিন পরে জ্ঞান হয়। স্মৃতিশক্তি তছনছ হয়ে গিয়েছিল। ডায়রি থেকে নাম ঠিকানা বার করে কলকাতার বাড়িতে খবর দেয়। এক ভাইপো চলে আসে। তাকে চিনতে পারিনি। হাসপাতালে থাকতেই কিছুটা স্মৃতি ফিরে আসে। চিকিৎসার ফলে আরও খানিকটা ইমপ্রুভ করেছে, কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টের ঠিক আগের ঘটনা এখনও ঠিক মনে পড়েনি। যেমন, ডি. জি. সেন বলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটা আমার ডায়রিতে পাচ্ছি কিন্তু তার চেহারাটা মনে পড়েছে মাত্র দুদিন আগে।
ডি. জি. সেন কেন গিয়েছিল কাঠমাণ্ডু, সেটা মনে পড়ছে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল—পুথি সংক্রান্ত কোনও ব্যাপার কি?
পুঁতি? একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। —যা দিয়ে মালা গাঁথে?
না, ফেলুদা হেসে বলল। —পুথি বা পুঁথি। পুস্তিকা। হাতে লেখা প্রাচীন বই। ভদ্রলোকের খুব ভাল কালেকশন আছে পুঁথির।
ও, তাই বলুন।
ভদ্রলোক চুপ করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, কী রকম দেখতে হয় বলুন তো এই পুঁথি?
সরু, লম্বা, চ্যাপটা, বলল ফেলুদা। — ধরুন স্টেট এক্সপ্রেসের একটা কার্টনের সাইজ। তার চেয়ে একটু ছাট বা বড়ও হতে পারে। সাধারণত শালুতে মোড়া থাকে।
ভদ্রলোক আবার কিছুক্ষণ চুপ। একদৃষ্টি চেয়ে আছেন টেবিল ল্যাম্পটার দিকে, আর আমরা চেয়ে আছি ভদ্রলোকের দিকে।
বেশ মিনিটখানেক পরে বিলাস মজুমদার বললেন, তা হলে বলি শুনুন। কাঠমাণ্ডুতে যে হোটেলে ছিলাম, বিক্রম হোটেল, সেখানে ভারী এক অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। দু-একটা ঘর ছিল যার চাবি অন্য ঘরে লেগে যেত—যেটা হোটেলে কখনওই হবার কথা না। এক’দিন আমি আমার ঘরের চাবি নিয়ে ভুল করে আমার পাশের ঘরের দরজায় লাগিয়ে ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। সেটা ছিল ডি. জি. সেন-এর ঘর। প্রথমে ঠিক ধরতে পারিনি। ভাবছি আমার ঘরে এরা কারা, ঢুকল কী করে। আসল ব্যাপারটা বুঝতেই সারি বলে বেরিয়ে আসি, কিন্তু ততক্ষণে একটা ঘটনা আমি দেখে ফেলেছি। খাটে বসে আছেন মিঃ সেন, আর চেয়ারে দুটি অচেনা লোক, তাদের একজন একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স থেকে একটি প্যাকেট বার করছে। যতদূর মনে পড়ে প্যাকেটটা ছিল। লাল, তবে সেটা কাগজ কি কাপড় তা মনে নেই।
তারপর? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
তারপর ব্ল্যাঙ্ক। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনি। এর পরের মেমরি হচ্ছে হাসপাতালে জ্ঞান হওয়া।
লালমোহনবাবু হঠাৎ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন—আরে মশাই, এমন ভাল গণৎকার রয়েছেন এই পুরীতে, আপনি তাঁর কাছে যান না একবারটি। যা ভুলে গেছেন, সব ডিটেলে বলে দেবেন।
কার কথা বলছেন?
লক্ষ্মণ ভট্টাচাৰ্য দি গ্রেট। ওই ডি. জি. সেনেরই বাড়ির এক তলার ভাড়াটে। যদি দ্বিধা হয় তো বলুন, আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমিই আপনাকে নিয়ে যাব। আপনি একটিবার ট্রায়াল দিয়ে দেখুন।
বলছেন?
ভদ্রলোকের যেন আইডিয়াটা ভালই লেগেছে।
একশোবার! বললেন লালমোহনবাবু—আপনার কপালে ওই আঁচলটার উপর আঙুল রেখে সব গড়গড় করে বলে দেবেন।
এটা এতক্ষণ বলা হয়নি—বিলাসবাবুর কপালের ঠিক মাঝখানে একটা আচিল, হঠাৎ দেখলে মনে হবে ভদ্রলোক বুঝি টিপ পরেছেন।
ভদ্রলোক কি ভিজিটর অ্যালাউ করেন? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
হোয়াই নট? বললেন লালমোহনবাবু।আপনি আর তপেশ যাবেন তো? সে আমি ওঁকে বলে রাখব, কোনও চিন্তা নেই।
ঠিক হল, আজই সন্ধ্যা ছটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হবে। ভদ্রলোকের ফি পাঁচ টাকা পঁচাত্তর শুনে বিলাসবাবু হেসেই ফেলেছিলেন। কিন্তু ফেলুদা হিসেব করে দেখিয়ে দিল দশজন খদ্দের হলেও ভদ্রলোকের মাসিক আয় হয়ে যায় প্রায় দু হাজার টাকা।
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে নিজের ভাগ্য গণনা করাবার ইচ্ছে না থাকলেও, বিলাস মজুমদারের স্মৃতি উদ্ধার হয় কি না দেখার জন্য ফেলুদার যথেষ্ট কৌতুহল রয়েছে।
০৫. মন্দিরের দিকটা
আজ ঠিকই করে রেখেছিলাম যে বিকেলে একটু মন্দিরের দিকটায় যাব। মন্দিরের চেয়েও রথটা দেখার ইচ্ছে বেশি। ফেলুদার কাছেই শুনলাম যে এই বিশাল রথ নাকি প্রতিবারই রথযাত্রার পর ভেঙে ফেলা হয়। আর তার কাঠ দিয়ে খেলনা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা হয়। পরের বছর আবার ঠিক একই রকম নতুন রথ তৈরি হয়।
যাবার পথে ফেলুদাকে কেন যেন অন্যমনস্ক মনে হচ্ছিল। হয়তো এই দুদিনে নতুন আলাপীদের সঙ্গে যে সব কথাবাতা হয়েছে, সেগুলো ওর মাথায় ঘুরছিল। একটা কথা ওকে না বলে পারলাম না–
আচ্ছা ফেলুদা, নেপালটা কীরকম বারবার এসে পড়ছে, তাই না? যে লোকটা খুন হল সে নেপালের লোক, বিলাসবাবু কাঠমাণ্ডু গিয়েছিলেন, দুর্গাগতিবাবু ঠিক সেই সময় কাঠমাণ্ডুতে ছিলেন…
তুই কি এতে কোনও তাৎপর্য খুঁজে পেলি?
না। তবে–
সমপাত মানে জানিস?
না তো।
সমপাত হল ইংরিজিতে যাকে বলে কেইনসিডেন্স। যতক্ষণ না আরও এভিডেন্স পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ কাঠমাণ্ডুর ব্যাপারটা একটা কোইনসিডেন্স বলে ধরতে হবে—বুঝলি?