মিস্টার মিত্তির।
অন্যদের থেকে একটু আলগা হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে একজন লম্বা ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে হাসছেন। বোঝা যাচ্ছে ইনি বেশ কয়েক’দিন সমুদ্রতটে ঘোরাফেরা করেছেন, কারণ সানগ্লাসটা খুলতেই চোখ থেকে কান অবধি একটা ফিকে লাইন দেখা গেল যেখানে চশমার ডাঁটিটা চামড়ায় রোদ লাগতে দেয়নি।
ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। প্রায় ফেলুদার মতোই লম্বা, সুপুরুষ বলা চলে, কালো চাপ দাড়ি আর গোঁফটা বেশ হিসেব করে ছাঁটা, কালো ট্রাউজারের ওপর চিজক্লথের শার্টটা হাওয়ায় সেঁটে আছে শরীরের সঙ্গে।
আপনার নাম শুনেছি, বললেন ভদ্রলোক।এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নাকি?
কেন বলুন তো?
একটা খুন হয়েছে শুনলাম যে। তাই ভাবলাম আপনি আবার জড়িয়ে পড়লেন কি कों।
ফেলুদা হেসে বলল, খুন হলেই জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় ঠিকই, কিন্তু কেউ না ডাকলে আর কী করে যাই বলুন।
আপনি তো নীলাচলে উঠেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
হোটেলে ফিরছেন?
হ্যাঁ।
ইয়ে—
ভদ্রলোক কী যেন বলতে গিয়ে ইতস্তত করছেন। ফেলুদা বলল, আপনাকে বুঝি আংটি সামলাতে হচ্ছে?
এটা আমি আগেই লক্ষ করেছি। ভদ্রলোক ডান হাতের তেলোয় তিনটে সোনার আংটি নিয়ে রয়েছেন, ফলে বেশ বোকা বোকা দেখাচ্ছে।
আর বলবেন না, বললেন ভদ্রলোক, আমাদের হোটেলের এক বাসিন্দা, কালই আলাপ হয়েছে, জলে নামবেন, তা বললেন এগুলো নাকি আঙুল থেকে খুলে আসে। বলুন তো কী ঝক্কি।
আংটির মালিক যে কে সে আর বলতে হবে না। ওই যে, নুলিয়ার হাত ধরে ছপ ছপ করে এগিয়ে আসছেন তিনি। সোনায় মোড় মিঃ হিঙ্গোরানি। ফেলুদাকে দেখে ভদ্রলোক গুড মর্নিং বলে একটা হাঁক দিলেন, তারপর আরও এগিয়ে এসে থ্যাঙ্ক ইউ বলে আংটিগুলো ফেরত নিয়ে আঙুলে পরে জানিয়ে দিলেন যে গোয়া, ওয়াইকিকি, মায়ামি, আকাপুলকো, নিস ইত্যাদি অনেক জায়গার সমুদ্রতটের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর, কিন্তু পুরীর মতো বিচ নাকি কোথাও নেই।
নতুন ভদ্রলোকটি এবার হিঙ্গোরানির কাছে বিদায় নিয়ে আমাদের সঙ্গ নিলেন। ফেলুদা বলল, আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হয়নি।
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, আমার নাম বললে হয়তো চিনবেন না, একটা বিশেষ লাইনে আমার কিছুটা কনট্রিবিউশন আছে, তবে সেটা সকলের জানার কথা নয়। আমার নাম বিলাস মজুমদার।
ফেলুদা ভুরু কুঁচকে ভদ্রলাকের দিকে চাইল। —আপনার কি পাহাড়-টাহাড়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে?
ভদ্রলোক অবাক। ——বাবা, আপনার জ্ঞানের পরিধি দেখছি—
না, না, ফেলুদা বিলাসবাবুর কথা শেষ করতে দিল না— তেমন কিছু নয়। গত মাসখানেকের মধ্যে কোথায় যেন বিলাস মজুমদার নামটা দেখেছি—বাধহয় কোনও পত্রিকায় বা খবরের কাগজে। মনে হচ্ছে তাতে মাউনটেনিয়ারিং বা ওই জাতীয় কিছুর উল্লেখ ছিল।
ঠিকই দেখেছেন। আমি মাউনটেনিয়ারিং শিখেছিলাম দাৰ্জিলিং-এর ইনস্টিটিউটে। আমার আসল কাজ হচ্ছে ওয়াইলন্ড-লাইফ ফোটাগ্রাফি। একটা জাপানি দলের সঙ্গে স্নো-লেপার্ডের ছবি তুলতে যাবার কথা ছিল। জানেন বোধহয়—হিমালয়ের হাই অলটিচিউডে মো-লোপার্ডের আস্তানা! দেখেছে। অনেকেই, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ছবি তোলা সম্ভব হয়নি জানোয়ারটার।
পথে আর কোনও কথা হল না। লালমোহনবাবু বার বার সপ্ৰশংস দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে দেখছেন সেটা লক্ষ করেছি।
হোটেলে ফিরে এসেই ফেলুদা চায়ের অর্ডার দিল। ভদ্রলোক চেয়ারে বসে প্রথমেই পকেট থেকে একটা ছবি বার করে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন।
দেখুন তো একে চেনেন কি না।
পোস্টকার্ড সাইজের ছবি। মাটিতে উবু হয়ে বসা চ্যাপটা টুপি পরা একটা লোক একটা অদ্ভুত জানোয়ারকে জাপটে ধরে আছে, আর আট-দশজন লোক সেই জানোয়ারটাকে দেখছে। মিঃ মজুমদার যে লোকটির দিকে আঙুল দেখাচ্ছেন তাঁকে আমরা চিনি।
এঁর কাছ থেকেই তো আসছি। আমরা, বলল ফেলুদা, যদিও চিনতে একটু সময় লাগে, কারণ ভদ্রলোক দাড়ি রেখেছেন।
মিঃ মজুমদার ছবিটা ফেরত নিয়ে বললেন, এইটেই জানার দরকার ছিল। বাড়ির গেটে ডি. জি. সেন নাম দেখলাম, কিন্তু তিনি এই ছবির ডি. জি. সেন কি না সে বিষয়ে শিওর হতে পারছিলাম না।
জানোয়ারটি প্যাঙ্গোলিন বলে মনে হচ্ছে! বলল ফেলুদা।
ঠিক তো!—ওই প্যাঙ্গোলিন নামটা কিছুতেই মনে পড়ছিল না। একরকম পিপীলিকাভুক। দেখে মনে হয় গায়ে বর্ম পরে রয়েছে।
বিলাসবাবু বললেন, প্যাঙ্গোলিনই বটে। নেপালে পাওয়া যায়। কাঠমাণ্ডুর এক হোটেলের বাইরে তোলা। ডি. জি.সেন ছিলেন তখন ওই হোটেলে। আমিও ছিলাম।
এটা কবেকার ঘটনা?
গত অক্টোবরে। আমি গেছি সেই জাপানি টিম আসবে বলে। জাপানের কাগজেও আমার তোলা ছবি-টবি বেরিয়েছে। জাপানি দলটিা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। স্বভাবতই আমি খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ি। কিন্তু শেষ অবধি আর যাওয়া হয়নি।
কেন, কেন? ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন জটায়ু! বুঝলাম লেপার্ড-টেপার্ড শুনে ভদ্রলোক একটা রোমাঞ্চের গন্ধ পেয়েছেন।
কপাল। বললেন মিঃ মজুমদার। একটা অ্যাক্সিডেন্টে জখম হয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিলাম তিন মাস।
আপনার বাঁ পা কি জখম পা? হঠাৎ প্রশ্ন করল ফেলুদা।
কেন বলুন তো? বা পায়ের শিন বোনটা ভেঙেছিল বটে; কিন্তু আমার হাঁটা দেখলে কি বোঝা যায়?
তা যায় না, বলল ফেলুদা, কাল একটা পায়ের ছাপ দেখেছিলাম বালিতে-জুতো-পরা পা, সঙ্গে-সঙ্গে বাঁ পাশে লাঠির ছাপ। ভাবলাম, হয় ন্যাটা, না হয় বাঁ পায়ে জখম। তা আপনি লাঠি ব্যবহার করেন না দেখছি।