বালির উপর দিয়ে কেউ হেঁটে গেছে। পুব থেকে পশ্চিমে। জুতোর ছাপের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ছাপ চলেছে, সেটা নিশ্চয়ই লাঠি। লালমোহনবাবু বেশ কিছুক্ষণ ছাপগুলোর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, জুতো অ্যান্ড লাঠি সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে, তবে বিশেষ তাৎপর্য…
তোপ্সে, তোর কী মনে হয়? ।
আমি বললাম, লোকে তো সাধারণত ডান হাতে লাঠি ধরে। এখানে দেখছি। ছাপটা বাঁ দিকে।
ফেলুদা আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে দিল, যার মানে সাবাস। তারপর বলল, ভদ্রলোক ন্যাটা হলে আশ্চর্য হব না।
আমরা যেখানটায় এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে লোক বলতে তিনটে নুলিয়ার বাচ্চা, তার মধ্যে একটা কাঁকড়া ধরছে, আর দুটো ঝিনুক কুড়োচ্ছে। ভিড়টা আরম্ভ হয় আরও এগিয়ে গিয়ে, যেখানে কাছাকাছির মধ্যে বেশ কয়েকটা বাঙালি হোটেল রয়েছে। আমরা আরও এগিয়ে যাব যাব করছি, এমন সময় পিছন থেকে ডাক এল।
মিস্টার গাঙ্গুলী!
ঘুরে দেখি জটায়ুর রুমমেট, সেই দোকানের মালিক। গোলগল হাসিখুশি মিশুকে লোক, আলাপ হতে জানলাম নাম শ্ৰীনিবাস সোম, দোকানের নাম হেমাঙ্গিনী স্টোর্স, হেমাঙ্গিনী ভদ্রলোকের মায়ের নাম।
যাইবেন না? ভদ্রলোক লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন। ছয়টায় টাইম দিসে কিন্তু।
লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখছিলেন; এবার কারণটা বুঝলাম। কিন্তু-কিন্তু ভাব করে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, আপনি তো বোধহয় নট ইন্টারেস্টেড তাই আপনাকে জোর করব না।
ব্যাপারটা কী?
ইয়ে, ইনি এক আশ্চর্য গণকের কথা বলছিলেন। কপালে আঙুল রেখে ভাগ্য বলে দেন।
কার কপালে?
যার ভাগ্য বলছেন তার, ন্যাচারেলি।
কপালের লিখন পড়তে পারেন বলছেন?
শুনে তো তাই মনে হচ্ছে।
ফেলুদা অবিশ্যি কপালের লেখা পড়াতে রাজি হল না। তাও আমরা দুজনে গণৎকারের বাড়ি অবধি গেলাম। ওঁদের সঙ্গে। গণৎকারের বাড়ি বলাটা অবিশ্যি ঠিক হল না; একটা তিনতলা বাড়ির একতলার দুটো ঘর নিয়ে থাকেন। ভদ্রলোক। সমুদ্রের ধার দিয়ে সোজা পুবদিকে নুলিয়া বস্তি লক্ষ্য রেখে গিয়ে যেখানে চেঞ্জারদের ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে, সেখানে বাঁয়ে বালির চড়াই উঠে ত্রিশ চল্লিশ গজ গেলে বালিতে বসা একটা পোড়ো বাড়ির কিছুটা দূরেই এই তিনতলা বাড়িটা। গেটের একদিকে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা সাগরিক, অন্যদিকে ডি. জি. সেন। পুরনো ধাঁচের হলেও, বেশ বাহারের বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকে একটা মাঝারি বাগানও আছে।
মালিক থাকেন। ওই তিনতলার ঘরে, বললেন শ্ৰীনিবাস সোম, আর একতলার বারান্দার পিছনে ওই যে দরজা, ওইটা হইল লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের ঘর।
গণৎকারের নামটা এই প্রথম শুনলাম। বারান্দায় যে আট-দশজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তারাও যে গণৎকারের কাছেই এসেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
লালমোহনবাবু জয় গুরু বলে সোম মশাইয়ের সঙ্গে গেট দিয়ে ঢুকে গেলেন।
***
কপাল কী বলছে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। লালমোহনবাবু ভীষণ উত্তেজিতভাবে এইমাত্র ঢুকেছেন আমাদের ঘরে। —অবিশ্বাস্য, অলৌকিক, অসামান্য! বললেন ভদ্রলোক,-সাড়ে সাতে হুপিং কফ, আঠারোয় আছাড়ে পড়ে মালাই চাকি ডিসলোকেশন, প্রথম উপন্যাস, স্পেকট্যাকুলার পপুলারিটি, সামনের বই কটা এডিশন হবে—সব গড় গড় করে বলে দিলেন।
স্কাইল্যাব মাথায় পড়বে কি না বলেছে?
ঠাট্টাই করুন। আর যাই করুন মশাই, আপনাকে একবারটি ধরে নিয়ে যাবই। আর, ইয়ে, বলেছেন আমার বন্ধুভাগ্য ভাল। শুধু তাই নয়, বন্ধুর চেহারার ডেসক্রিপশনও দিলেন।
আর বন্ধুর পেশা?
বলেছেন বন্ধু মেধাবী, কর্মঠ, অনুসন্ধিৎসু, গভীর পর্যবেক্ষণ-শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। মিলছে? আর কী চাই?
মে আই কাম ইন?
হোটেলের ম্যানেজার শ্যামলাল বারিক ঘরে ঢুকতেই সুগন্ধি জিদার গন্ধে ঘর ভরে গেল। —আসুন। পানের ডিবে খুলে এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে। আমরা ইতস্তত করছি দেখে আশ্বাস দিলেন যে এ পানে জর্দা নেই।
ফেলুদা একটা পান মুখে পুরে চারমিনারের প্যাকেটটা পকেট থেকে বার করে বলল, আচ্ছা, এই ডি. জি. সেন ভদ্রলোকটির পুরো নামটা কী?
দেখেছেন? বলে উঠলেন লালমোহনবাবু, ওঁর বাড়ি থেকেই ঘুরে এলুম, অথচ ওঁর পুরো নামটা জেনে এলুম না। দোলগোবিন্দ নয় তো?
আমি জানি, ভদ্রলোকের পিঠাপুরমের পিশাচ বইতে একটা আধপাগলা চরিত্র আছে যার নাম দোলগোবিন্দ দত্ত রায়।
শ্যামলালবাবু হেসে বললেন, মাপ করবেন মশাই, ওঁর পুরো নাম আমারও জানা নেই। কেউই জানেন কি না সন্দেহ। সবাই ডি. জি. সেন বলেই বলেন। এমনকী ডিজিবাবুও বলতে শুনেছি কাউকে কাউকে।
বেশি মেশেন-টেশেন না বুঝি?
গোড়ায় তবু এখানে সেখানে দেখা যেত। গত বছর সিকিম না। ভূটান কোথায় যেন গিয়েছিলেন; মাস ছয়েক হল ফিরে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে।
কেন, সেটা জানেন?
শ্যামলালবাবু মাথা নাড়লেন।
বাড়িটা কি ওঁরই তৈরি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
না। ওঁর বাপের। বাপের পরিচয় দিলে হয়তো চিনতে পারেন। সেন পারফিউমারস-এর নাম শুনেছেন তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—কিন্তু সে ব্যবসা তা উঠে গেছে অনেককাল। এস. এন. সেনস সেনসেশন্যাল এসেনসেজ—সেই সেন তো?
ঠিক বলেছেন। ইনি ওই এস. এন. সেনের ছেলে। জোর ব্যবসা ছিল। কলকাতায় তিনটে বাড়ি, মধুপুরে একটা, পুৱীতে একটা। ভদ্রলোক মারা যাবার পর ব্যবসা আর বেশিদিন টেকেনি। দুই ছেলের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে দেন উইল করে। ডি. জি. সেন বোধহয় ছোট ছেলে; তিনি এই বাড়িটা পান। দুই ছেলের কেউই ব্যবসায় যায়নি। ইনি এককালে চাকরি-টাকরি করে থাকতে পারেন, এখন আর্ট নিয়ে আছেন।