এই নিন আপনার কল্পসূত্র।
ফেলুদা সদ্য-পাওয়া পুঁথিটা দুর্গাগতিবাবুর হাতে দিলেন। ভদ্রলোক একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তক্ষুনি আবার গভীর হয়ে গিয়ে উৎকণ্ঠার সুরে বললেন, আর অন্যটা?
সেটার কথায় আসছি, বলল ফেলুদা। —আপনি একটু ধৈর্য ধরুন। আপনি আজ আবার ঘুমের ওষুধ খাননি তো?
পাগল! ঘুমের ওষুধই তো আমার সর্বনাশ করল। কাল কী মিশিয়ে দিয়েছিল জলের সঙ্গে কে জানে?
দুর্গাগতিবাবু গভীর বিরক্তির ভাব করে পুলিশের হাতে বন্দি লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের দিকে চাইলেন।
ফেলুদা বলল, এত ভাল একজন অ্যালোপ্যাথ থাকতে আপনি এই হাতুড়ে হামবাগটিকে প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন কেন বলুন তো?
কী করব বলুন! লোক যাচাই করার ক্ষমতা কি আর ছিল? সবাই এত সুখ্যাত করলে, যেচে এল আমার কাছে, বললে নিজের গরজে আমাকে সারিয়ে দেবে। আরও বললে, ওর সন্ধানে ভাল পুঁথি আছে—জ্যোতিষশাস্ত্রের পুঁথি…
ওই তো মুশকিল। পুঁথির কথা বললেই আপনার মন গলে যায়। যাই হোক ডায়াপিডে কাজ দিয়েছে তা? লুপ্ত স্মৃতি ফিরিয়ে আনার পক্ষে ওটাই তো সবচেয়ে নতুন আর সবচেয়ে ভাল ওষুধ বলে।
আশ্চর্য ওষুধ, বললেন মিঃ সেন, মুহূর্তে মুহূর্তে যেন স্মৃতির এক-একটা দরজা খুলে যাচ্ছে। সেনাপতি নিজে এসে ওষুধটা দিল বলেই তো হল। সেই যে আমার ডাক্তার সে কথাও তো ভুলে গিয়েছিলাম!
তা হলে বলুন তো, এই ভদ্রলোককে চেনেন কি না।
ফেলুদা তার টর্চ ফেলল বিলাস মজুমদারের মুখে। দুর্গাগতিবাবু তাঁর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, কালকেই চিনেছিলাম। গলার স্বর আর চাহনি থেকে। কেন যে তবু খটকা লাগছিল জানি না।
এর নামটা মনে পড়ছে?
পরিষ্কার—যদি না উনি নাম ভাঁড়িয়ে থাকেন।
সরকার কি? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
সরকার, সায় দিয়ে বললেন দুর্গাগতিবাবু। পুরো নামটা কোনওদিন জানিনি।
লায়ার! চোখমুখ লাল করে চিৎকার করে উঠলেন অভিযুক্ত ভদ্রলোক। পাসপোর্ট দেখতে চান আমার?
না, চাই না-বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল ফেলুদা। —আপনার মতো ধূর্ত লোকের পাসপোর্টের কী মূল্য? কী আছে পাসপোর্টে? বিলাস মজুমদার নাম আছে তো? আর চেহারার বিশেষত্বর মধ্যে কপালের আঁচিলের কথা বলেছে?—ডিসটিংগুইশিং মার্ক-মোল অন ফোরহেড– এই তো? তবে দেখুন–
কথাটা বলেই ফেলুদা ভদ্রলোকের দিকে হনহানিয়ে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে এক ঝটিকায় একটা রুমাল বার করে সেটা দিয়ে একটা চাপড় মারুল ভদ্রলোকের কপালে, আর তার ফলে কৃত্রিম আচিল কপাল থেকে খুলে ছিটুকে গিয়ে পড়ল অন্ধকারে মেঝেতে।
আপনি বিলাস মজুমদার সম্বন্ধে অনেক খবর নিয়েছিলেন, ফেলুদা বলল দৃপ্তকণ্ঠে, স্নো লেপার্ডের ছবি তুলতে গিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া, কোন হাসপাতালে গিয়েছিল, কী কী হাড় ভেঙেছিল, গত মাস অবধি সে হাসপাতালে ছিল-এ সবই আপনি জানতেন। কিন্তু একটি সংবাদ আপনার কানে পৌঁছয়নি। খবরের কাগজে সেই সংবাদটাই আমি পড়েছিলাম, কিন্তু তেমন মন নিয়ে পড়িনি। খবরটা কালকে আমি পেয়েছি। কাঠমাণ্ডুর বীর হাসপাতালের ডাঃ ভাৰ্গবের কাছ থেকে। সেটা হল এই—বিলাস মজুমদারের সবচেয়ে মারাত্মক ইনজুরি হয়েছিল ব্রেনে। তিন সপ্তাহ আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
লণ্ঠনের আলোতেও বুঝতে পারছি লোকটার মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে।
শুনুন মিঃ সরকার, ফেলুদা বলে চলল, আপনার পেশা পাসপোর্টে লেখা যায় না। আপনার পেশা স্মাগলিং। নিজে সব সময় চুরি না করলেও, চোরাই মাল পাচার করেন আপনি। ভাতগাঁওয়ের প্যালেস মিউজিয়াম থেকে চুরি করা পুঁথি আপনার হাতে আসে কাঠমাণ্ডুতে। তার পরের ঘটনা যে কী, সেটা শুনুন মিস্টার সেনের মুখে।
দুৰ্গতি সেনের চাহনিতে এমন কঠিন গান্তীর্যের ভাব এর আগে দেখিনি। ভদ্রলোক বললেন :
কাঠমাণ্ডুতে একই হোটেলে ছিলাম। এই ভদ্রলোক আর আমি। পাশাপাশি ঘর-এক’দিন ভুল করে আমার চাবি ওঁর ঘরে লাগিয়ে দেখি দরজা খুলে গেছে। ভেতরে উনি ছাড়া দুজন লোক, তাদের একজন বাক্স থেকে একটা লাল মোড়ক বার করে ওঁকে দিচ্ছে। দেখেই বুঝলাম পুঁথি। খটকা লাগল। মাপা চেয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। সেই রাত্রে ঘুমের মধ্যে কী হল জানি না, জ্ঞান হল হাসপাতালে। মাথা ব্ল্যাঙ্ক। এই ঘটনার আগের সব স্মৃতি মন থেকে মুছে গেছে! হোটেলে খোঁজ করে আমার নাম-ঠিকানা পায়, এখানে খবর দেয়, নিশীথ গিয়ে আমাকে নিয়ে আসে। সাড়ে তিন মাস ছিলাম হাসপাতালে।
আপনার না-জানা অংশ আমি বলছি, বলল ফেলুদা, ভুল হলে মিঃ সরকার যেন শুধরে দেন। –আপনাকে সেই রাত্রে অজ্ঞান করে গাড়িতে নিয়ে তুলে শহরের বাইরে গিয়ে পাহাড়ের গা দিয়ে পাঁচশো ফুট নীচে ফেলে দেওয়া হয়। মিঃ সরকারের ধারণা ছিল আপনার মৃত্যু হয়েছে। ন মাস পরে হয়তো চোরাই মাল পাচার করতেই পুৱীতে এসে ডি. জি. সেন নাম দেখে খটকা লাগে। আমার ধারণা আপনার বাড়ির একতলার বাসিন্দা গণহুকার লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে আপনার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যাবতীয় ইনফরমেশন পান মিঃ সরকার। তাই নয় কি?
ঝিমিয়ে পড়া লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য হঠাৎ যেন চাঙ্গা হয়ে উঠলেন—এ সব কী বলছেন। মশাই–উনি তো আপনাদের সঙ্গে প্রথম এলেন আমার বাড়িতে!
বটে?—ফেলুদা এগিয়ে গেছে লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের দিকে। তা হলে বলুন তো গণৎকার মশাই, পরিচয় হবার আগেই আপনি কেন ভদ্রলোককে তক্তপোশে বসতে বললেন আর আমাদের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন? উনিই যে বিলাস মজুমদার, আমি নই, সেটা আপনি কী করে জানলেন?