ওর জাপানি বাইনোকুলার।
ফেলুদা কী দেখছে জানি।
দুৰ্গতি সেনকে দেখা যাচ্ছে ওঁর শোবার ঘরের জানালায়, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দু পা বাঁয়ে সরে ডান হাত বাড়িয়ে কী জানি একটা তুললেন।
গেলাস।
কী খেলেন ভদ্রলোক গেলাস থেকে?
একতলার ঘরে বাতি এইমাত্র নিভে গেছে, এবার তিনতলার বাতি নিম্ভল, আর নিভতেই আমাদের আশেপাশের অন্ধকার যেন হঠাৎ আরও গাঢ় হয়ে গেল।
কিন্তু এখনও আমাদের মধ্যে কেউ নড়াচড়া করলে বেশ বুঝতে পারছি।
যেমন লালমোহনবাবু তাঁর পকেট থেকে টৰ্চটা বার করলেন।
কিন্তু কেন? কী মতলব ভদ্রলোকের?
আমি বুকে পড়ে ওঁর কানের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে বললাম, জ্বালাবেন না, খবরদার ভদ্রলোক উত্তরে আমার কানে মুখ এনে বললেন, ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট, হাতে থাক।
উনি মুখ সরিয়ে নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা জিনিস দেখে আমার হৃৎপিণ্ডটা এক লাফে গলার কাছে চলে এল।
ইনে হাত দশেক দূরে আরেকটা হাগলার ছাউনি।
তার পাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।
কখন এসেছে জানি না।
লালমোহনবাবুও দেখেছেন, কারণ ওঁর কাঁপা হাত থেকে টৰ্চটা ঝুপ শব্দ করে বালির উপর পড়ে গেল।
আর ফেলুদা?
ও দেখেনি।
ওর দৃষ্টি সোজা সাগরিকার দিকে।
আমিও জোর করে চোখ সেই দিকেই ঘোরালাম।
আর তাই বোধহয় ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটাকে দেখতে পেলাম।
সাগরিকার দিক থেকে লোকটা আসছে আমাদের দিকে।
না, এই দিকে না। ভুজঙ্গ নিবাসের দিকে।
লোকটাকে চেনার কোনও উপায় নেই।
এগিয়ে এল। ওই তা ভুজঙ্গ নিবাসের গেটের থাম।
গেটের কাছাকাছি পৌঁছে লোকটা হাঁটার গতি কমাল, তারপর হাটা থামল।
এবারে আরেকটা লোক। এতক্ষণ দেখিনি। বোধহয় বাড়িটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল।
দ্বিতীয় লোকটা প্ৰথম লোকটার দিকে এগিয়ে গেল।
গেটের সামনে এখন দুজন লোক।
এবার দুজনে ভাগ হল। যে সাগরিকার দিক থেকে এসেছিল সে আবার ফিরে—
সর্বনাশ! লালমোহনবাবুর অসাবধান আঙুলের চাপে ওঁর পাগলা টর্চ জ্বলে উঠেছে!
ফেলুদা এক থাপ্পড়ে টর্চটা বালিতে ফেলে দিল, আর সেই মুহূর্তে লালমোহনবাবুর চার ইঞ্চি ডাইনের বাঁশের খুঁটিটাতে কান-ফটানো শব্দের সঙ্গে একটা গুলি এসে লাগল।
তুই ওটাকে ধর।
ফেলুদা হাউইয়ের মতো লাফিয়ে উঠে ছুটে গেছে দ্বিতীয় লোকটাকে লক্ষ্য করে।
আশ্চর্য এই যে ওই একটা কথাতেই দেখলাম যে বিপদের তোয়াক্কা না করে আমিও নিঃশব্দে তীরবেগে ছুটতে শুরু করেছি। বালির উপর দিয়ে প্রথম লোকটাকে লক্ষ্য করে।
ফেলুদার আর আমার পথ ভাগ হয়ে গেল।
রাগবি খেলায় যেমন ফ্লাইং ট্যাকল করে একজন খেলোয়াড় আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জাপটে ধরে, আমিও ঠিক সেই ভাবে অব্যৰ্থ লক্ষ্যে লোকটার পা দুটোকে জাপটে ধরলাম।
লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল বালির ওপর। আমি লোকটার পিঠে, আমার দৃষ্টি ঘুরে গেছে ফেলুদার দিকে।
একটা হাড়ে-হাড়ে সংঘর্ষের শব্দের সঙ্গে ফিকে আকাশের সামনে দেখলাম একটা ছায়ামূর্তি আরেকটা ছায়ামূর্তিকে ঘুঁসি মেরে ধরাশায়ী করল।
ইতিমধ্যে লালমোহনবাবু এসে পড়েছেন, এবং এসেই মহা বিক্রমে আমার হাতে বন্দি লোকটার মাথা লক্ষ্য করে তাঁর হাতের ব্লান্ট ইনস্টুমেন্টটা নিক্ষেপ করেছেন। একটা ভোঁতা শব্দে বোঝা গেল হাতিয়ার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এখন বালিতে লুটাপুটি খাচ্ছে।
ওকে নিয়ে আয় এদিকে।
আমরা দুজনে লোকটার দুই পা ধরে বালির উপর দিয়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গেলাম যেখানে রয়েছে ওরা দুজন। ফেলুদা দাঁড়ানো, অন্য লোকটি চিত, ফেলুদার একটা পা তার পেটের উপর, আর অন্যটা ডান হাতের তেলোর উপর–যে হাত থেকে রিভলভারটা আলগা হয়ে পড়ে আছে বালিতে।
আপনার থুতনিতে ক্ষতচিহ্ন ছিল না, কিন্তু আজ থেকে থাকবে।
আমার ওয়াইল্ড লাইফ কথাটা মনে পড়ল। অদ্ভূত হিংস্ৰ চেহারা নিয়ে টর্চের তীব্র আলোতে কপাল কুঁচকে ফেলুদার দিকে চেয়ে আছেন বিলাস মজুমদার, তাঁর বাঁ হাতে আঁকড়ানো রয়েছে লাল শালু দিয়ে মোড়া একটা পুঁথি।
ফেলুদা ঝুকে পড়ে এক ঝটিকায় পুঁথিটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের ঝোলার মধ্যে রেখে দিল।
তারপর ওর টর্চ ঘুরে গেল আমাদের বন্দির দিকে।
আপনার থার্ড আই কী বলছে লক্ষ্মণবাবু? শেষটায় এই ছিল আপনার কপালে?
অন্ধকার থেকে আরও লোক বেরিয়ে এসেছে।
আসুন মিঃ মহাপাত্র, ফেলুদা হাঁক দিল। —এঁদের দুজনকে তুলে দিচ্ছি। আপনাদের হাতে, তবে কাজ ফুরোয়নি। আমরা হত্যাপুরীর বৈঠকখানায় একটু বসব। এরা দুজনও থাকবেন।
চারজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে বিলাসবাবু আর লক্ষ্মণবাবুকে তুলে নিল।
মহিমবাবু আছেন তো! ফেলুদা পিছনের অন্ধকারের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল।
আছি বইকী।
অন্ধকার থেকে সেই রহস্যজনক চতুর্থ ব্যক্তি বেরিয়ে এলেন। —বাবাও এসে পড়লেন বলে। ওই যে টর্চের আলো।
কোনও চিন্তা নেই, বললেন, মিঃ মহাপাত্র, মোড়া এনে রাখা হয়েছে। ঘরে—সবাই বসতে পারবেন।
লালমোহনবাবুর বাইরেই তো বেশ– কথাটা কারুর কানে গেল কি না জানি না, কারণ সবাই রওনা দিয়েছে ভুজঙ্গ নিবাসের দিকে।
১২. অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা
আসুন, মিঃ সেন, আপনার জন্যই ওয়েট করছি।
ফেলুদা এগিয়ে গেছে। দরজার দিকে।
মহিমবাবু তাঁর বাবাকে নিয়ে ঢুকলেন। তিনটে লণ্ঠন জ্বলছে ঘরের ভিতর। পুলিশের লোক ঝাড়পোঁছ করে ঘরের চেহারা ফিরিয়ে দিয়েছে।
দুর্গাগতিবাবু আর মহিমবাবু দুটো পাশাপাশি মোড়ায় বসলেন।