পায়ের ছাপগুলো ফেলুদা খুব মন দিয়ে দেখল। প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে, কারণ ক্ৰমাগতই হাওয়ার সঙ্গে বালি এসে তার উপর জমা হচ্ছে।
কিন্তু জুতোর ছাপ তাতে সন্দেহ নেই।
এ ছাড়াও আর একটা জিনিস আছে সেটা পা দিয়ে খানিকটা বালি সরাতেই বেরিয়ে পড়ল।
আমার মনে হল পানের পিক, যদিও লালমোহনবাবুর মতে নিঃসন্দেহে ব্লাড।
লালমোহনবাবু একবার মৃদুস্বরে ব্রেকফাস্ট কথাটা বলতে বুঝলাম ওঁর আর এগোতে সাহস হচ্ছে না। আমারও বুক টিপটপ করছে, কিন্তু ফেলুদা নির্বিকার।
তা হলে হত্যাপুরীতে একবার প্রবেশ করতে হয়।
এটা জানাই ছিল। এতদূর এসে পায়ের ছাপটাপ দেখে ফেলুদা চট করে পিছিয়ে যাবে না।
ক্যাঁ—চ শব্দে দরজার দুটো পাল্লাই খুলে গেল ফেলুদার দু হাতের চাপে।
বাদুড়ে গন্ধ। বাইরে থেকে ভিতরের কিছুই দেখা যায় না, কারণ ভিতরে জানালা থেকে থাকলেও তা নিশ্চয়ই বন্ধ। আর দরজা দিয়ে যে আলো ঢুকবে তার পথ আপাতত আমরাই বন্ধ করে রেখেছি।
ফেলুদা চৌকাঠ পেরোল। আমি জানি ঘুটঘুটে রাত্তির হলেও ও দ্বিধা করত না, তফাত হত এই যে ওর সঙ্গে তখন হয়তো ওর কোল্ট রিভলভারটা থাকত।
আসুন ভিতরে।
আমি ঢুকে গেছি, কিন্তু লালমোহনবাবু এখনও চৌকাঠের বাইরে। —অল ক্লিয়ার কি? অস্বাভাবিক রকম চড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
ক্লিয়ার তো বটেই। আরও ক্লিয়ার হবে ক্ৰমে ক্ৰমে। এসে দেখুন না। কী আছে। ঘরের মধ্যে।
আমি অবিশ্যি এর মধ্যেই দেখে নিয়েছি।
প্রথমেই চোখে পড়েছে একটা টিনের ট্রাঙ্ক আর শতরঞ্চিতে মোড়া একটা বেডিং। ঘরের এক পাশে দেয়ালের সামনে যেমন-তেমন করে ফেলে রাখা হয়েছে সে দুটো।
পুলিশের পণ্ডশ্রম, বলল ফেলুদা,নিশীথবাবু যাননি।
তবে কোথায় গেলেন ভদ্রলোক? লালমোহনবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ফেলুদা কথাটা গ্রাহ্য করল না।
হুঁ-ভেরি ইন্টারেস্টিং।
ঘরের এক কোণে স্তুপ করে রাখা রয়েছে সরু আর লম্বা-করে কাটা কাঠ, আর পাশেই ফিতোয় মোড়া দিস্তা দিস্তা ফিকে হলদে রঙের সস্তা কাগজ।
বলুন তো এ থেকে কী বোঝা যায়, ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ও তো পুঁথির কাঠ বলে মনে হচ্ছে। আর ওই, ইয়ে—
লালমোহনবাবু এত সময় নিচ্ছেন কেন জানি না। আমি বললাম, মনে হচ্ছে নিশীথবাবু একেবারে ব্যবসা খুলে বসেছিলেন—ডামি পুঁথি তৈরি করার। সাইজমাফিক কাগজ কেটে দুদিকে কাঠ চাপা দিয়ে শালুতে মুড়ে দিলে বাইরে থেকে ঠিক পুঁথি।
এগজ্যাক্টলি, বলল ফেলুদা—আমার বিশ্বাস, সেন মশাইয়ের সব পুঁথিগুলো বার করে খুললে দেখা যাবে তার অনেকগুলোই কেবল সাদা কাগজ। আসলগুলো পাচার হয়ে গেছে। হিঙ্গোরানি সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে।
ও হা হা!—লালমোহনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন—সাপ, সাপ। সেদিন একটা কাগজের ফালি দেখেছিলাম সাগরিকার গলিতে—সে তা হলে এই কাগজ।
নিঃসন্দেহে, বলল ফেলুদা।
এর পরে যে ঘটনাটা ঘটল সেটা লিখতে আমার হাত না কাঁপলেও, বুক কাঁপছে।
বৈঠকখানায় ঢুকেই ডাইনে-বাঁয়ে মুখোমুখি দুটো দরজা রয়েছে পাশের দুটো ঘরে যাবার জন্য। লালমোহনবাবু ডান দিকের দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা সামনের দরজা খুলে ঢোকাতে সেটা দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে সমুদ্রের বাতাস ঢুকিছিল। একটা দমকা হাওয়ার ফলে হঠাৎ ডাইনের দরজাটা প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল, লালমোহনবাবু চমকে উঠে খোলা দরজাটার দিকে চাইলেন, আর চাইতেই তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল। ভদ্রলোক পড়েই যেতেন যদি না ফেলুদা এক লাফে গিয়ে ওঁকে জাপটে ধরে ফেলত।
এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা লোক চোখ উলটে মরে পড়ে আছে পাশের ঘরের মেঝেতে।
তার মাথা থেকে বেরোনো রক্ত চাপ বেঁধে আছে মেঝের উপর।
লোকটাকে চিনতে কোনওই অসুবিধা হল না।
ইনি দুগাৰ্গতি সেনের সেক্রেটারি নিশীথ বাস।
১১. ফেলুদার আর ব্রেকফাস্ট খাওয়া হল না
ফেলুদার আর ব্রেকফাস্ট খাওয়া হল না।
রেলওয়ে হোটেল থেকে টেলিফোনে পুলিশ খবর দিয়ে আমরা আমাদের হোটেলে চলে এলাম। ফেলুদা বলল যে ওর দু-একটা কাজ আছে, বিশেষ করে নুলিয়া বস্তিতে একবার যাওয়া দরকার, কাজেই ও একটু পরে ফিরবে। লাশ ছোঁয়াছুয়ি না করেই ও বলল যে, বাঝাই যাচ্ছে লোকটাকে মারা হয়েছে একটা ব্লান্ট ইনস্টুমেন্ট দিয়ে—যদিও সে ধরনের কোনও হাতিয়ার কাছাকাছির মধ্যে পেলাম না।
লালমোহনবাবু না জেনে মোক্ষম নাম দিয়েছিলেন বাড়িটার এটা স্বীকার করতেই হবে, যদিও পরে বলেছিলেন যে পুরী কথাটা বাড়ি অর্থে ব্যবহার করেননি। উনি মিন করেছিলেন পুরী শহর।তিন দিনের মধ্যে দু-দুটো খুন, হত্যাপুরী ছাড়া আর কী?
একটা সুখবর দিয়ে রাখি। দুর্গাগতিবাবুর সঙ্গে তাঁর ছেলের মিটমাট হয়ে গেছে। অন্তত দেখে তাই মনে হল। আমরা যখন ভুজঙ্গ নিবাস থেকে বেরোচ্ছি, তখন সাগরিকার দিকে চোখ পড়তে দেখি ছাতে দুজন লোক। বাপ আর ছেলে। শুধু তাই নয়, ছেলে আমাদের দিকে হাত নাড়লেন, কাজেই বুঝলাম খোশ মেজাজে আছেন। এটাও আমার কাছে কম রহস্য নয়।
ফেলুদা যখন ঘরে এসে ঢুকাল তখন পৌনে এগারোটা। আমার মনে পড়ে গেল নেপালে টেলিফোনের কথাটা। বললাম, কলটা পেয়েছিলে?
এই তো কথা বলে আসছি।
কলটা কি কাঠমাণ্ডুতে করেছিলে?
উঁহু, পাটন। কাঠমাণ্ডুর কাছেই বাঘমতী নদী পেরিয়ে একটা পুরনো শহর।
লালমোহনবাবু বললেন, যাই বলুন, লাশের কাছে ভূত কিছুই না। এখনও ভাবলে শিভারিং হচ্ছে।