ফুটপ্রিন্টস… ফেলুদা বলে উঠল।
একটু এগিয়ে গিয়েই দেখতে পেলাম টাটকা পায়ের ছাপ। জুতো, আর সেই সঙ্গে বাঁ হাতে ধরা লাঠি।
বিলাসবাবু খুব আলি রাইজার বলে মনে হচ্ছে, মন্তব্য করলেন লালমোহনবাবু।
বিলাসবাবু? বিলাসবাবু বলে মনে হচ্ছে কি? দেখুন তো ভাল করে—দূরে সামনের দিকে দেখিয়ে বলল ফেলুদা।
এত দূর থেকেও বুঝতে পারলাম, যিনি বালিতে দাগ ফেলতে ফেলতে এগিয়ে চলেছেন তিনি মোটেই বিলাসবাবু নন।
তই তো! বললেন লালমোহনবাবু, ইনি তো দেখছি আমাদের সেনসেশনাল সেন সাহেব।
ঠিক ধরেছেন। দুগাৰ্গতি সেন।
কিন্তু তা হলে গেঁটে বাত?
সেইখানেই তো ভেলকি! লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের ওষুধের গুণ বোধহয়?
মনে ধাঁধাটে ভাব নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। রহস্যের পর রহস্য যেন ঢেউয়ের পর ঢেউ।
বাঁয়ে রেলওয়ে হোটেল দেখা যাচ্ছে। ডাইনে গোটা পাঁচেক নুলিয়া আর সুইমিং ট্রাঙ্কস পরা তিনজন সাহেব। তার মধ্যে একজন ফেলুদার দিকে হাত তুললেন।
গুড মর্নিং!
আন্দাজে বুঝলাম ইনিই কালকের সেই পুলিশকে ফোন করা আমেরিকান।
আমরা এগিয়ে গেলাম। ওই যে হিঙ্গোরানি আসছেন, কাঁধে তোয়ালে। ভারী অপ্ৰসন্ন মনে হচ্ছে ভদ্রলোককে। আমাদের দিকে দেখলেনই না।
আমার মন কেন জানি বলছে ফেলুদা সাগরিকায় যাচ্ছে, কারণ ও সমুদ্রের ধারের বালি ছেড়ে বাঁয়ে চড়াইয়ে উঠতে শুরু করেছে। সূর্যের আধখানা কিন্তু এর মধ্যেই উঠে বসে আছে। ফেলুদার মাথা বিশালত্বের সামনে পড়ে পরিষ্কার হয়েছে কি?
প্ৰাতঃপ্ৰণাম।
গণৎকার মশাই এগিয়ে এসেছেন বালির উপর দিয়ে, লুঙ্গিটা খাটা করে পরা, কাঁধে তোয়ালে, হাতে নিমের দাঁতন।
কাল কোথায় ছিলেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
কখন?
সন্ধেবেলা; আপনার খোঁজ করেছিলাম।
ওহো। কাল গোসলাম কের্তন শুনতে। মঙ্গলাঘাট রোডে একটা কের্তনের দল আছে; মাঝে-মধ্যে যাই।
কখন গিয়েছিলেন?
আমার তো ছটার আগে ছুটি নেই। তারপরেই গোসলাম।
আপনি তো ও বাড়ির বাসিন্দা, তাই ভাবছিলাম চুরির ব্যাপারে যদি কোনও আলোকপাত করতে পারেন। আপনার ঘর থেকে পশ্চিমের গলিটা তো দেখা যায়।
তা তো যায়ই, তবে পশ্চিমের গলিতে যা দেখেছি তাতে খুব অবাক হইনি, বললেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। নিশীথবাবুকে দেখলাম তল্পিতল্পা নিয়ে বেরুতে। তা উনি যে কলকাতায় যাবেন সেটা তো ক’দিন থেকেই ঠিক ছিল।
তাই বুঝি?
ওঁর মা-র যে এখন—তখন অবস্থা। টেলিগ্রাম এসেছিল। ক’দিন আগে।
বটে? আপনি দেখেছিলেন সে টেলিগ্ৰাম?
শুধু আমি কেন? সেন মশাইও দেখেছিলেন।
ফেলুদা অবাক।
আশ্চর্য! সেন মশাই তো সে কথা বললেন না।
সে আর কী বলব বলুন! উনি মানুষটা কী রকম সেটা তো আপনারাও দেখলেন। দুভোগ আছে আর কী। কপালের লিখন খণ্ডায় কার সাধ্যি বলুন!
আপনি মিঃ সেনেরও ভাগ্য গণনা করেছেন নাকি? ভারী ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। লালমোহনবাবু।
এ তল্লাটে কার করিনি? কিন্তু করলে কী হবে? সবাইকে তো আর সব কথা বলা যায় না। অবিশ্যি ব্যারাম-ট্যারামের লক্ষণ দেখলে বলি; তাই বলে, আপনি খুন করবেন, আপনার। জেল হবে, ফাঁসি হবে, অপঘাতে মৃত্যু আছে আপনার—এসব কি বলা যায়? তা হলে আর কেউ আসবে না মশাই। আসলে লোকে ভালটাই শুনতে চায়। তাই অনেক হিসেব করে ঢেকে ঢুকে বলতে হয়।
লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য বিদায় জানিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে গেলেন। আমরা এগিয়ে চললাম সাগরিকার দিকে। সকালের রোদ পড়ে বাড়িটাকে সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছে।
হত্যাপুরী, বললেন লালমোহনবাবু।
সে কী মশাই প্রতিবাদের সুরে বলল ফেলুদা, হত্যা কোথায় হল যে হত্যাপুরী বলছেন? বরং চুরিপুরী বলতে পারেন।
নট সাগরিকা বললেন লালমোহনবাবু। —আমি এ দিকের বাড়িটার কথা বলছি।
সাগরিক থেকে আন্দাজ ত্রিশ গজ। এই দিকে বালিতে বসে যাওয়া এই বাড়িটার কথা আগেই বলেছি। লালমোহনবাবু খুব ভুল বলেননি। এমনিতেই পোড়া নোনাধরা বাড়ি দেখলে কেমন গা ছমছম করে, এটার আবার তলার দিকের হাত-পাঁচেক বালিতে বসে যাওয়াতে, আর কাছাকাছি অন্য কোনও বাড়ি না থাকতে সত্যিই বেশ ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল। দিনের বেলাতেই এই রাত্রে না জানি কী রকম হবে।
অন্যান্য দিন বাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে যাই, আজ একটু কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারল না বোধহয় ফেলুদা। ফটকের থামগুলো এখনও রয়েছে, তার একটার গায়ে কালসিটে মেরে যাওয়া শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা ভুজঙ্গ নিবাস। বালি আর এক হাত উঠলেই ফলকটা ঢাকা পড়ে যাবে। ফটিক পেরিয়ে বোধহয় এককালে একটা ছোট্ট বাগান ছিল, তারপরেই সিঁড়ি উঠে গিয়ে বারান্দা। সিঁড়ির শুধু ওপরের দুটো ধাপ বেরিয়ে আছে, বাকিগুলো বালির নীচে। বারান্দার রেলিং ক্ষয়ে গেছে, ছাত যে কেন ধসে পড়েনি জানি না। বারান্দার পরে যে ঘর, সেটা নিশ্চয়ই বৈঠকখানা ছিল।
একেবারে পরিত্যক্ত বলে তো মনে হচ্ছে না, ফেলুদা মন্তব্য করল। করার কারণটা স্পষ্ট। লোকের যাতায়াত আছে, সেটা বারান্দার বালির উপর পায়ের ছাপ থেকে বোঝা যায়।
আর দেশলাইয়ের কাঠি, ফেলুদা।
একটা নয়, তিন-চারটে। সিঁড়ি উঠেই বারান্দার বা দিকের থামটার পাশে।
সমুদ্রের হাওয়ায় সিগারেট ধরাতে গেলে কাঠি খরচা একটু বেশি হবেই।
আমরা ফটকের মধ্যে ঢুকলাম। সাংঘাতিক কৌতুহল হচ্ছে বাড়িটার ভিতরে ঢোকার। দরজা নিশ্চয়ই খোলা যায়, কারণ দমকা বাতাসে সেটা খটখট করে নড়ছে; একেবারে যে খুলছে না, সেটা ঘরের মেঝেতে জমে থাকা বালিতে বাধা পাওয়ার জন্য।