কেন?
কারণ লোকটা ছিল ঘোর অত্যাচারী এবং অহংকারী। এর মধ্যেও দেখছি সেই পূর্বপুরুষের রক্ত কিছুটা বইছে। অথচ রবার্টসন সাহেব কিন্তু একবারেই সেরকম নন, সত্যি করেই ভারতবর্ষ ও ভারতীয়দের ভালবাসেন।
চা পর্ব সেরে দুবরাজপুরের দুমাইলের মধ্যে হেতমপুরে কয়েকটা সুন্দর টেরা কোটা মন্দির দেখে আমরা লাঞ্চের আগেই টুরিস্ট লজে ফিরে এলাম! হেতমপুরের মন্দিরের গায়ে দুশো বছরের পুরনো থামে মেমসাহেবের মূর্তি দেখে রবার্টসন মুগ্ধ। ম্যাক্সওয়েলের দেখলাম মন্দির সম্বন্ধে কোনও কৌতূহল নেই। সে রাস্তার ধারে টিউবওয়েলে এক মা তার বাচ্চাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল, তারই কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল।
হেতমপুর থেকে চৌবে বিদায় নেবার আগে ফেলুদা তাকে একটা প্রশ্ন করল।
আপনার সঙ্গে তো ঢানাগনিয়ার যথেষ্ট পরিচয় আছে দেখলাম। লোকটা কেমন?
চৌবে বলল, পরিচয় মানে ও আমাকে হাতে রাখতে চায়। ওর নানারকম সব ধোঁয়াটে কারবার আছে, তাই পুলিশের সঙ্গে ওর দোস্তি রাখাটা দরকার। আমি অবশ্য ওর খাতিরের মানে বুঝি এবং সব সময়ই চোখ কান খোলা রাখি। গোলমাল দেখলে আমি ওকে রেহাই দেব না। তবে লোকটা ধনী। ওই রুবির জন্য দশ লাখ দিতে ওর গায়ে লাগবে না।
ওঁর ছেলে কি ওর বাপের ব্যবসা দেখে?
কিশোরীলালের নিজের ইচ্ছা নেই বাপের ব্যবসায় থাকার। সে নিজে একটা কিছু করতে চায়, এবং সেই নিয়ে তার বাপের সঙ্গে কথাও হয়েছে। গণেশ তার ছেলেকে খুব ভালবাসে, তাই শেষ পর্যন্ত সে রাজিও হয়ে যেতে পারে।
আই সি।
ভাল কথা-আপনাদের কালকের প্ল্যান কী?
কাল ভাবছি সকালে একবার কেন্দুলির মেলাটা দেখে আসব।
আপনারা সবাই যাবেন? ইনকুডিং এই দুই সাহেব?
সেরকমই তো মনে হয়।
তা হলে আপনাকে বলে দিই–আপনি এই ম্যাক্সওয়েল ছাকরাটির উপর একটু দৃষ্টি রাখবেন। ওর ব্যবহার আমার মাথায় দুশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
নিশ্চয়ই রাখব।
লজে ফিরে এসে আরও দুজনের সঙ্গে আলাপ হল—তাদের কথা এই বেলা লিখে রাখি।
এক–মিস্টার নস্কর। ইনি কলকাতার একজন নাম-করা ধনী ব্যবসায়ী। ইনি আগেই দুটোর সময় নিজের গাড়িতে এসে পৌঁছেছেন।
দুই–জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। ইনি বালপুরেই থাকেন। স্টেটসম্যানে পিটারের লেখাটা পড়ে সোজা আমাদের সঙ্গে এসে দেখা করে বললেন উনি বীরভূম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। এখানকার প্রত্যেকটি টেরা কোটা মন্দির ওঁর দেখা এবং সে ব্যাপারে উনি সাহেবদের খুব সাহায্য করতে পারেন। পিটার তাঁকে বলে দিল ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে।
মিঃ নস্কর-পরে জেনেছিলাম পুরো নাম অর্ধেন্দু নস্কর-স্টুরিস্ট লজে এসে লাউঞ্জে আমাদের দেখা পেলেন। আমরা সবাই তখন লাঞ্চের ডাক কখন পড়বে তার অপেক্ষায় বসে আছি। ভদ্রলোক এসে ঢুকতে আমাদের সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, কারণ চেহারাটা বেশ চোখে পড়ার মতো! টকটকে গায়ের রং, ফ্রেঞ্চ কাট কালো দাড়ি, চোখে রিমালেস চশমা, পরনে গাঢ় নীল সুটের সঙ্গে জামার উপর কালো নকশা করা স্কার্ফ।
ভদ্রলোক দুজন সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে মিঃ রবার্টসন? বলতেই পিটার উঠে দাঁড়িয়ে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। ভদ্রলোক করমর্দন করে বললেন, মই নেম ইজ ন্যাস্কার। আমি স্টেটসম্যানে তোমার লেখাটা পড়ে খোঁজখবর করে তোমার সঙ্গে দেখা করব বলে সোজা এখানে চলে আসছি আমার গাড়িতে।
হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
নস্কর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পিটারের মুখোমুখি বসে বলল, আগে তোমার মুখ থেকে আমি একটা কথা শুনতে চাই…
কী?
দেড়শো বছর আগে তোমার পূর্বপুরুষ তাঁর ডায়রিতে যে বাসনার কথা লিখেছেন, তুমি কি সত্যিই সেটা পূরণ করতে এদেশে এসেছ?
অ্যাবসোলিউটলি, বলল। পিটার।
তুমি কি অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করা? তোমার কি সত্যিই ধারণা যে রুবিটা ভারতবর্ষে ফেরত দিলে তোমার পূর্বপুরুষের আত্মা শাস্তি পাবে?
পিটার শুকনো গলায় উত্তরটা দিল।
আমি কী বিশ্বাস করি বা না করি সেটা জানার কী দরকার? যতদূর বুঝছি আপনি রুবিটা কেনার প্রস্তাব করছেন। আমার উত্তর হল আমি ওটা বেচব না।
তুমি তোমার দেশের জহুরিকে এটা দেখিয়েছ?
দেখিয়েছি।
রুবির দাম তার মতে কত হতে পারে?
টেগয়েন্টি থাউজ্যান্ড পাউন্ডস।
পাথরটা কি হাতের কাছে আছে? সেটা একবার দেখতে পারি কি?
পাথরটা টমের কাছেই ছিল; সে ব্যাগ থেকে কৌটোটা বার করে নস্করকে দিল। মিঃ নস্কর কৌটোটা খুলে পাথরটা বার করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তারপর পিটারের দিকে ফিরে বলল, তোমাদের দুজনের কাউকেই তো তেমন ধনী বলে মনে হচ্ছে না।
তার কারণ, বলল। পিটার, আমরা ধনী নই। কিন্তু এও বলতে পারি যে আমরা লোভীও নাই।
আমরা দুজনে কিন্তু এক ছাঁচে ঢালা নাই, টম ম্যাক্সওয়েল হঠাৎ বলে উঠল।
তার মানে? নস্কর শুধোলেন।
পিটার বলল, আমার বন্ধু বলতে চাইছে যে এ ব্যাপারে আমাদের দুজনের মধ্যে মতের সম্পূর্ণ মিল নেই। অর্থাৎ, রুবিটা বিক্রি করে দু পয়সা রোজগারের ব্যাপারে তার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু রুবিটা তো ওর প্রপার্টি নয়, আমার প্রপাটি; কাজেই ওর কথায় তেমন আমল না দিলেও চলবে।
টম দেখি। গম্ভীর হয়ে গেছে, তার কপালে গভীর খাঁজ।
এনিওয়ে, বললেন নস্কর, আমি এখানে আরও তিনদিন আছি। শান্তিনিকেতনে আমার বাড়ি রয়েছে। আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখৰ্ব্ব। অত সহজে আমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না মিস্টার রবার্টসন। আমি আপনাকে বারো লাখ টাকা দিতে রাজি আছি। আমার মূল্যবান পাথরের সংগ্ৰহ সারা ভারতবর্ষে পরিচিত। এত বড় একটা রোজগারের সুযোগকে আপনারা কেন হেলাফেলা করছেন জানি না। আশা করি ক্রমে আপনাদের মত পরিবর্তন হবে।