ফেলুদা বলল, আমাদের সঙ্গে কি দুজন সাহেব যেতে পারেন?
বেশ তো-তারাও ওয়েলকাম।
শতদলবাবু চলে গেলেন।
সকালে স্নান করে বেরিয়েছিলাম, তাই ঘরে মালপত্তর রেখে প্রথমেই লাঞ্চটা সেরে নিলাম। শাস্তিনিকেতনে সত্যিই শান্ত পরিবেশ, তাই ফেলুদার রেস্ট হবে ভাল; ও সম্প্রতি দুটো মামলা করে এসেছে। প্রথমটা মনে হয়েছিল আত্মহত্যা, কিন্তু শেষটায় দাঁড়াল খুন, আর দ্বিতীয়টা জালিয়াতি। দুটোই বেশ ঝামেলার কেস ছিল, তাই ওরা এখন সত্যিই বিশ্রামের দরকার।
ডাইনিং রুমেই পিটার আর টমকে আমাদের বিকেলের প্ল্যানটা বলে দিলাম। পিটার তৎক্ষণাৎ রাজি, যদিও টম কিছুই বলল না। পিটার এও বলল যে এর মধ্যেই ও দুবরাজপুরের এক ধনী ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টেলিফোন পেয়েছে। ফোনটা করেছিল তাঁর ছেলে, কারণ ভদ্রলোকের ইংরিজিটা নাকি তেমন সড়গড় নয়। পিটার বলল, ভদ্রলোক আমার রুবির খবরটা পেয়েছেন এবং সেটা কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমি অবিশ্যি বলতে বাধ্য হলাম যে আমি ওটা বেচব না। তাতে ভদ্রলোক ছেলেকে দিয়ে বললেন যে পাথরটা তাঁর একবার দেখার ইচ্ছে। আশা করি সে সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করব না।
ভদ্রলোকের নাম কী?
জি. এল. ড্যানড্যানিয়া।
ঢানঢানিয়া। বুঝলাম। কখন অ্যাপিয়েন্টমেন্ট?
কাল সকাল দশটা।
আমরা আসতে পারি কি?
নিশ্চয়ই। আপনারা এলে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করব। ইন ফ্যাক্ট, আপনারা ভাল দোভাষীর কাজ করতে পারবেন। দুবরাজপুর আর তার পাশেই হেতমপুরে তো ভাল টেরা কোটার মন্দির আছে বলে ম্যাককাচন লিখেছে। কথা সেরে না হয় সেগুলো দেখে আসব।
শুধু মন্দির না, ফেলুদা বলল, দুবরাজপুরে আরও দেখার জিনিস আছে। হাতে সময় থাকলে সেও দেখা যেতে পারে।
হরিপদবাবু অ্যাম্বাসডর নিয়ে পৌনে চারটেয় এসে পৌঁছালেন। পথে বর্ধমানে খেয়ে নিয়েছিলেন, বললেন আমরা বেরোতে চাইলে বেরোতে পারি। —আমার বিশ্রামের কোনও দরকার নেই, স্যার।
আমরা আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম। পিয়ার্সন পল্লী থেকে শতদল সেনকে তুলে নিয়ে ছজনে গিয়ে হাজির হলাম। উত্তরায়ণে। পিটার এরকম বাড়ি এর আগে দেখেনি, বলল, ইট লুকাস লাইক এ ফেয়ারি টেল প্যালেস।
উদীচী, শ্যামলীও দেখা হল। কোনওখানেই পভার্টির ছাপ নেই বলেই বোধহয় ম্যাক্সওয়েল তার ক্যামেরা বারই করল না।
লালমোহনবাবু সব দেখেটেখে বললেন, নো স্যার, এই অ্যাটমোসফিয়ারে এখন প্রখর রুদ্রর প্লষ্ট বেরোবে না; তার জন্য চাই ক্যালকাটার পরিবেশ।
ফেরবার পথে পিটার আর টম একটা সাইকেল রিকশা ধরল। পিটার বলল, কাছেই একটা ট্রাইব্যাল ভিলেজ আছে, টম তার কিছু ছবি তুলতে চায়।
বুঝলাম সাঁওতাল গ্রামের কথা বলা হচ্ছে।
সাহেবদের বিদায় দিয়ে আমরা আমাদের ঘরে এসে অন্ত্যাক্ষরী খেলে বিকেলটা কাটিয়ে দিলাম। যাবার সময় শতদলবাবু তাঁর থলি থেকে একটা বই বার করে জটায়ুকে দিয়ে বললেন, এই নিন—লাইফ অ্যান্ড ওয়র্ক ইন বীরভূম, লেখক এক পাদ্রি, নাম রেভারেন্ড প্রিচার্ড। একশো বছর আগের লেখা বই। ইন্টারেস্টিং তথ্যে বোঝাই। পড়ে দেখবেন।
উনি না পড়লেও আমি নিশ্চয়ই পড়ব। বলল ফেলুদা।
পরদিন সকালে সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট সারা হল। দুবরাজপুর এখান থেকে ২৫ কিলোমিটার, যেতে আধা ঘণ্টার বেশি লাগবে না। ঢানচানিয়ার ছেলে ওদের বাড়িটা কোথায় সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল, আর তা ছাড়া এও বলেছিল যে দুবরাজপুরে ওটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাড়ি।
আমরা দশটার পাঁচ মিনিট আগেই একটা উঁচু দেয়ালে ঘেরা বাড়ির লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম, গেটের গায়ে ফলকে লেখা জি. এল. ঢানগনিয়া।
সশস্ত্ৰ দারোয়ান একবার আমাদের মুখটা দেখে নিয়েই গেট খুলে দিতে বুঝলাম যে তাকে বলা হয়েছে সাহেবরা আসছে।
গেট খুলে দিতে গাড়ি ঢুকে খানিকটা মোরামফেলা পথ দিয়ে গিয়েই সদর দরজার সামনে পৌঁছে গেলাম। দরজার সামনে একটা স্কুটার ধরে একজন বছর পাঁচিশের ছেলে, সে আমাদের দেখেই স্কুটারটা এক পাশে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে এল। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। পিটার এগিয়ে গেল যুবকের দিকে। হাত বাড়িয়ে বলল, মই নেম ইজ পিটার রবার্টসন। ইউ মাস্ট বি কিশোরীলাল?
হ্যাঁ। আমি কিশোরীলাল ঢানঢানিয়া। আমার বাবা আপনাদের সঙ্গে অ্যাপায়েন্টমেন্ট করেছেন। চলুন, আমি আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি।
আমার এই তিনজন ভারতীয় বন্ধুও যেতে পারেন তো?
নিশ্চয়ই।
আমরা কিশোরীলালকে অনুসরণ করে বাড়ির ভিতর ঢুকে একটা উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দাতলায় উঠে দুটো ঘর আর একটা বারান্দা পেরিয়ে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
জুতো খুলতে হবে কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
না না, কোনও দরকার নেই! কিশোরীলালের বাংলায় বেশ একটা টান আছে।
আমরা বৈঠকখানায় ঢুকলাম।
বেশ বড় ঘর। দরজা জানালায় রঙিন কাচ, তাই দিয়ে আলো এসে ঘরটাকে বেশ রংদার করে তুলেছে। ঘরের অর্ধেকটা ফরাস পাতা, বাকি অংশটায় সোফা চেয়ার ইত্যাদি রয়েছে।
মালিক বসে আছেন ফরাসের এক প্রান্তে, শীর্ণকায় চেহারায় একটা প্ৰকাণ্ড তাগড়াই গোঁফ। একটা অদ্ভুত বৈপুরীত্য এনেছে। চারপাশে তাকিয়া ছড়ানো। মালিক ছাড়াও ঘরে রয়েছেন বছর পঞ্চাশেকের একটি ভদ্রলোক, পরনে ছাই রঙের প্যান্টের সঙ্গে খয়েরি রঙের জ্যাকেট। ইনি আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়ালেন।
পিটার ঢানঢানিয়াকে উদ্দেশ করে ভারতীয় ভঙ্গিতে একটা নমস্কার করে বলল, মিঃ ড্যানড্যানিয়া, আই প্রিাজিউম।