টমের ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদা ছিলেন বীরভূমে এক নীলকুঠির মালিক। জামানরা কৃত্রিম উপায়ে নীল বার করে সস্তায় বাজারে ছাড়ার পর ভারতবর্ষ থেকে নীলের চাষ উঠে যায়। তখন টমের পূর্বপুরুষ রেজিনাল্ড ম্যাক্সওয়েল দেশে ফিরে যান। আমাদের দুজনেরই একই ভ্রমণের নেশা আর তার থেকে বন্ধুত্ব। টম একজন পেশাদার ফোটাগ্রাফার। আমি ইস্কুল মাস্টারি করি।
টমের পাশেই কামরার মেঝেতে রাখা একটা ব্যাগ দেখে আন্দাজ করেছি। তাতে ক্যামেরার সরঞ্জাম রয়েছে।
তোমরা ক’দিন বীরভূমে থাকবে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
দিন সাতেক, বলল। পিটার রবার্টসন। আসল কাজ কলকাতাতেই, কিন্তু বাংলার কিছু টেরা কোটা মন্দির দেখার শখ আছে।
বীরভূমে অবিশ্যি মন্দির ছাড়াও বেশ কিছু দেখবার জিনিস আছে! একবার গিয়ে পড়লে একসঙ্গে ঘুরে দেখা যাবে। ভাল কথা-তোমার স্টেটসম্যানের লেখার কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি?
কী, বলছ! –লেখা বার হবার তিনদিনের মধ্যে স্টেটসম্যানে চিঠি আসতে শুরু করে। লেখকদের মধ্যে রাজারাজড়ার ম্যানেজার আছে, ধনী ব্যবসাদার আছে, রত্ন সংগ্ৰাহক আছে। এরা সকলেই রুবিটা কিনতে চায়। আমি আমার লেখার মধ্যে স্পষ্টই বলে দিয়েছি যে ওটা আমি বিক্রি করব না। রবার্টসনের রুবি নিয়ে আমাদের দেশেও রত্ন সংগ্রাহকদের মধ্যে চাঞ্চল্য পড়ে গেছে অনেকদিন থেকে। তারা ওটার জন্য কত টাকা দিতে প্রস্তুত তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না। আমি লন্ডনে যাচাই করিয়ে দেখেছি, এটার মূল্য হচ্ছে টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড পাউন্ডস।
পাথরটা বোধহয় তোমার কাছেই রয়েছে?
ওটা টমের জিন্মায়। এ ব্যাপারে ও আমার চেয়ে অনেক বেশি সাবধান। তা ছাড়া ওর রিভলভার আছে, প্রয়োজনে সেটা ব্যবহার করতে পারে।
পাথরটা কি একবার দেখা যায়?
নিশ্চয়ই।
পিটার টমের দিকে দৃষ্টি দিল। টুম তার ক্যামেরার ব্যাগ খুলে তার মধ্যে থেকে একটা নীল মখমলের বাক্স বার করল। ফেলুদা তার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে খুলতেই আমাদের তিনজনের মুখ দিয়ে একসঙ্গে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে পড়ল। শুধু যে এমন পাথর এর আগে দেখিনি তা নয়-এমন লাল রংও আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ল না।
ফেলুদা পাথরটা কিছুক্ষণ হাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ইটস্ অ্যামেজিং! বলে সেটা ফেরত দিয়ে দিল। তারপর টম ম্যাক্সওয়েলকে উদ্দেশ করে বলল, আপনার রিভলভারটা একবার দেখতে পারি? ও বিষয়ে আমার কিঞ্চিৎ জ্ঞান আছে।
কথাটা বলে ফেলুদা তার পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে পিটারের হাতে দিল।
পিটারের চোখ কপালে উঠে গেল।
সে কী-তুমি যে দেখছি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর? তা হলে তো আমাদের কোনও গণ্ডগোল হলে তোমার শরণাপন্ন হতে হবে।
গণ্ডগোল আশা করি হবে না, যদিও সেটা নির্ভর করছে ম্যাক্সওয়েল সাহেবের উপর, কারণ পাথরটা ওঁর জিন্মায় রয়েছে।
ইতিমধ্যে ম্যাক্সওয়েল তার রিভলভারটা বার করেছে, এবার সেটা ফেলুদাকে দেখতে দিল। দেখেই বুঝলাম সেটা ফেলুদার কোল্ট না, অন্য কোম্পানির তৈরি।
ওয়েরলি স্কট, বলল ফেলুদা। তারপর রিভলভারটা ফেরত দিয়ে বলল, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
নিশ্চয়ই।
তোমার এটার দরকার হয় কেন?
ফোটাগ্রাফির নেশা আমাকে নানান জায়গায় নিয়ে যায়। অনেক দুৰ্গম জায়গায় আমি গিয়েছি, জংলি উপজাতিদের ছবি তুলেছি। বুঝতেই পারছি সঙ্গে একটা অস্ত্র থাকলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। এই রিভলভার দিয়ে আমি অ্যাফ্রিকায় ব্ল্যাক মাম্বা সাপ পর্যন্ত মেরেছি।
ভারতবর্ষে এর আগে কখনও এসেছ?
না, এই প্ৰথম।
ছবি তোলা শুরু করে দিয়েছ?
কলকাতার কিছু জনবহুল অঞ্চলের ছবি তুলেছি।
তার মানে বস্তি?
হ্যাঁ। আমি যেই পরিবেশে মানুষ সেরকম পরিবেশের ছবি তোলার কোনও ইচ্ছা আমার নেই। তার থেকে যত অন্যরকম হয় ততই ভাল; আমার মনে হয়, পভাটি ইজ মোর ফোটোজেনিক দ্যান প্রসপেরিটি।
ফোটো-হোয়াট? প্রশ্নটা করলেন জটায়ু।
ফোটাজেনিক, বলল ফেলুদা। অর্থাৎ চিত্ৰগুণসম্পন্ন।
লালমোহনবাবু বিড়বিড় করে বাংলায় মন্তব্য করলেন, এ, কি বলতে চায় হাড়হাভাতেরা আর মোর. ফোটোজেনিক দ্যান যারা খেয়ে-পরে আছে?
ম্যাক্সওয়েল বলল, কাজেই এখানেও আমাদের ওই কথাটা মনে রাখতে হবে? ওই কথা মনে রেখেই আমি এখানেও ছবি তুলব।
ভদ্রলোকের কথাগুলো আমার কেন জানি অদ্ভুত লাগছিল। পিটার ভারতবর্ষকে ভালবাসে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু তার বন্ধুর মনোভাব এত অন্যরকম হয় কী করে? এই বন্ধুত্ব টিকবে তো?
বর্ধমানে চা-ওয়ালা ডেকে ভাঁড়ে চা খাওয়া হল, সেই চা-ওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে তার ছবি তুললেন ম্যাক্সওয়েল। ।
বোলপুর স্টেশনে পৌঁছে সাইকেল রিকশার ভিড় দেখে ম্যাক্সওয়েল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু পিটার তাকে জানিয়ে দিল যে স্টেশনে এত সময় নষ্ট করা চলবে না।
চারটে রিকশা নিয়ে মালপত্তর সমেত আমরা যখন বোলপুর টুরিস্ট লজে পৌঁছলাম তখন একটা বেজে দশ মিনিট।
০৩. লালমোহনবাবুর বন্ধু শতদল সেন
স্টেশনে লালমোহনবাবুর বন্ধু শতদল সেন এসেছিলেন। লালমোহনবাবুরই বয়সী, ফরসা রং, মাথায় ঢেউ খেলানো কালো চুল। অনেকদিন পরে একজনকে দেখলাম যিনি লালমোহনবাবুকে লালু বলে সম্বোধন করলেন। ভদ্রলোক নিজেও অবিশ্যি হয়ে গেলেন সতু।
যে যার ঘরে যাবার আগে টুরিস্ট লজের লাউঞ্জে বসে কথা হচ্ছিল। শতদলবাবু বললেন, তোদের গাড়ি বলছিস তিনটে নাগাত আসবে। তারপর তোরা চলে আসিস আমার ওখানে। পিয়ার্সন পল্লীতে খোঁজ করলেই আমার বাড়ি দেখিয়ে দেবে। নাম শান্তিনিলয়। তোদের একবার উত্তরায়ণ কমপ্লেক্সটা দেখিয়ে আনব।