ঠিকই শুনেছেন। দলে দলে বাউল আসে। সেই মেলাতে।
সেটা ঠিক কখন হয় মশাই?
এই এখন। মকর সংক্রাস্তিতে শুরু হয়েছে।
হোয়াট ইজ দ্য বেস্ট ওয়ে টু গো?
লালমোহনবাবুর মাঝে মাঝে একটা সাহেবি মেজাজ প্রকাশ পায়। উনি বলেন সেটা ওঁর গল্প লেখার জন্য অনেক ইংরেজি বই কনসাল্ট করতে হয় বলে।
ফেলুদা বলল, সত্যিই যেতে চাইছেন বীরভূম?
ভেরি ম্যাচ সো।
তা হলে আমি বলি কী, আপনি হরিপদবাবুকে বলুন সোজা আপনার গাড়ি নিয়ে বোলপুর চলে যেতে। আমরা সেদিনই শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চলে যাব। যাবার আগে অবশ্য টুরিস্ট লজে বুকিং করে নিতে হবে। ফাস্ট ট্রেন; শুধু বর্ধমানে থামে; আড়াই ঘণ্টায় শান্তিনিকেতন পৌঁছে যাব।
ট্রেনেই যাব বলছেন?
তার কারণ আছে। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে লাউঞ্জ করে বলে একটা ফাস্ট ক্লাস এয়ারকন্ডিশনড় বগি থাকে। এতে করিডর নেই, সেই আদ্যিকালের কামরার মতো চওড়া। পঁচিশ ত্ৰিশজন যায়, বৈঠকখানার মতো সোফা কাউচ টেবিল পাতা রয়েছে। এ সুযোগ ছাড়া উচিত নয়।
জিহ্বা দিয়ে লালাক্ষরণ হচ্ছে মশাই। তা হলে একটা কাজ করি। –শতদলকে একটা পোস্টকার্ড ড্রপ করে দিই।
শতদলটা কে?
শতদল সেন। এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়িচি, এখন বিশ্বভারতীর ইতিহাসের অধ্যাপক। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল মশাই, আমি ওকে কোনওদিন টেক্কা দিতে পারিনি।
তার মানে আপনিও ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন বলছেন?
তা বাংলার জনপ্রিয়তম থ্রিলার রাইটার সম্বন্ধে সেটা কি বিশ্বাস করা খুব কঠিন ব্যাপার?
—তা আপনার বর্তমান আই কিউ-৫ পর্যন্ত বলে ফেলুদা আর কথাটা শেষ করল না। বলল, লিখে দিন আপনার বন্ধুকে।
দুদিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। বোলপুর টুরিস্ট লজে একটা ডাবল আর একটা সিঙ্গল রুম বুক করা হয়েছে। গরম কাপড় বেশ ভালরকম নিতে হবে, কারণ এটা জানুয়ারি মাস, শান্তিনিকেতনে কলকাতার চেয়ে বেশি শীত। ইতিমধ্যে আমি ডেভিড ম্যাককাচনের বইটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। দেখে অবাক লাগছিল যে একজন লোক কী করে এত জায়গায় ঘুরে এত খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেছে। বাংলার এই আশ্চর্য সম্পদ সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই ছিল না।
শনিবার সকালে লালমোহনবাবুর সবুজ অ্যাম্বাসাডর নিয়ে হরিপদবাবু বেরিয়ে পড়লেন। পানাগড় অবধি গিয়ে ডাইনে ঘুরতে হবে, তারপর অজয় নদী পেরিয়ে ইলামবাজার দিয়ে বোলপুর।
আমরা সাড়ে নটায় হাওড়া স্টেশনে জড়ো হলাম। লালমোহনবাবু বললেন, আমার দুদিন থেকে ডান চোখটা নাচছে; সেটা গুড সাইন না ব্যান্ড সাইন, মশাই?
ফেলুদা বলল, আপনি খুব ভাল করেই জানেন আমি ও ধরনের কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না, তাও কেন জিজ্ঞেস করছেন বলুন তো!
লালমোহনবাবু কেমন যেন মুষড়ে পড়ে বললেন, একবার ভাবলুম এটা হয়তো কোনও আসন্ন তদন্তের লক্ষণ; তারপর মনে হল ট্যাগোরের সঙ্গে ক্রাইমের কোনও রকম সম্পর্ক থাকা একেবারেই অসম্ভব। কাজেই ওটা আপনি মন থেকে দূর করে দিতে পারেন, ফেলুবাবু।
০২. ইংরিজিতে বলে কোইন্সিডেন্স আর বাংলায় কাকতালীয়
লালমোহনবাবু অবশ্য পরে বললেন, ওটাই হচ্ছে, ওঁর ডান চোখ নাচার কারণ, আমার কিন্তু মনে হল ব্যাপারটা যাকে ইংরিজিতে বলে কোইন্সিডেন্স আর বাংলায় কাকতালীয়।
লাউঞ্জ করে সবসুদ্ধ চব্বিশ জন বসতে পারে, কিন্তু উঠে দেখি আমাদের নিয়ে রয়েছে মাত্র দশ জন; তার মধ্যে আবার দুজন সাহেব। একজনের সোনালি চুল, দাড়িগোঁফ নেই, আরেকজনের কালো চাপ দাড়ি আর কাঁধ অবধি লম্বা চুল। বয়স ফেলুদার চেয়ে কিছু কমই হবে-মানে ত্ৰিশের সামান্য বেশি। আমার মন কিন্তু বলল এর মধ্যে একজন নিশ্চয়ই পিটার রবার্টসন।
সেটা যে সত্যি সেটা জানা গেল গাড়ি ছাড়ার দশ মিনিটের মধ্যেই।
একটা সোফায় আমরা তিনজন পাশাপাশি বসেছি, সত্যিই বুঝতে পারছি এরকম আরামের কামরা এর আগে কখনও দেখিনি। ফেলুদা একটা চারমিনার বার করে মুখে পুরে লাইটারটা দিয়ে সেটা ধরিয়েছে এমন সময় সোনালি চুল-ওয়ালা সাহেব মুখে একটা সিগারেট পুরে ফেলুদার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, মে আই–?
ফেলুদা লাইটারটা সাহেবের হাতে দিয়ে বলল, আর ইউ গোইং টু বোলপুর টু?
সাহেব সিগারেটটা ধরিয়ে লাইটারটা ফেরত দিয়ে হাসিমুখে ফেলুদার দিকে হ্যান্ডশোকের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, ইয়েস। মই নেম ইজ পিটার রবার্টসন, অ্যান্ড দিস ইজ মই ফ্রেন্ড টম ম্যাক্সওয়েল।
ফেলুদা এবার আমাদের তিনজনেরই পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, তোমার লেখাই তো সেদিন স্টেটসম্যানে পড়ছিলাম না?
ইয়েস। ডিড ইউ লাইক ইট?
অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক লেখা। সেই রুবি কি তুমি কাউকে দিয়ে দিয়েছ?
না। ওটা আমাদের সঙ্গেই আছে। আমরা কলকাতার মিউজিয়ামকে ওটা অফার করেছি। ঘটনাটা কিউরেটরকে জানিয়েছি। উনি বলেছেন। উনি অত্যন্ত খুশি হবেন পাথরটা মিউজিয়ামের জন্য পেলে। উনি অবশ্য ব্যাপারটা দিল্লিতে জানিয়েছেন। ওখান থেকে অনুমতি পেলেই আমরা পাথরটাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিউজিয়মের হাতে তুলে দেব। কিউরেটর বললেন ভারতবর্ষের অনেক সম্পাদই নাকি বিদেশে চলে গেছে, তার সামান্য অংশও যদি এইভাবে ফেরত পাওয়া যেত তা হলে কত ভাল হত।
তোমার তো ইন্ডিয়ার সঙ্গে একটা যোগসূত্র রয়েছে; তোমার বন্ধুরাও আছে নাকি?
উত্তরটা বন্ধু নিজেই দিতে পারতেন, কিন্তু দিলেন পিটার রবার্টসন।