তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার দাদার শরীর-স্ট্ররীর খারাপ হয়নি তো? দেখে কেন জানি মনে হচ্ছিল রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি।
ঘুম হয়েছে, তবে অনেক রাত অবধি আপনার দেওয়া বইটা পড়েছে এটা আমি জানি। অবিশ্যি তাও সেই সকল সাড়ে পাঁচটায় উঠে যোগব্যায়াম করেছে।
তোপ্সে!
ফেলুদার গলা, সেই সঙ্গে দরজায় ধাক্কা। দরজা খুললাম।
ফেলুদা ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে বলল, চলুন। –বেরোতে হবে। চৌবের ওখানে। দেরি নয়–ইমিডিয়েটলি।
আমরা তৈরিই ছিলাম, তিনজন বেবিয়ে পড়লাম।
দুবরাজপুর থানায় গিয়ে গাড়িটা থামল। আমরা তিনজন নামলাম। একজন কনস্টেবল জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে এল।
একটু ইনস্পেক্টর চৌবের সঙ্গে দেখা করব।
আসুন।
আমরা চৌবের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। ভদ্রলোক কাগজপত্র দেখছিলেন, আমাদের দেখে অবাক আর খুশি মেশানো দৃষ্টি দিয়ে আমাদের দিকে চাইলেন।
কী ব্যাপার?
একটু কথা ছিল।
বসুন, বসুন।
আমরা তিনজন চৌবের টেবিলের উলটোদিকে তিনটে চেয়ারে বসলাম।
চা খাবেন তো?
নো থ্যাঙ্কস। একটু আগেই ব্রেকফাস্ট খেয়েছি।
তা বলুন কী ব্যাপার।
মাত্র একটা প্রশ্ন।
বলুন, বলুন।
আপনি কি ক্রিশ্চান?
চৌবের চোখ কপালে উঠে গেল। তারপর একটা সরল হাসি হেসে বললেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন?
আমি জানতে চাই। প্লিজ বলুন।
ইয়েস, আই অ্যাম এ ক্রিশচীন-কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?
আপনাকে আমি চারবার খেতে দেখেছি। প্রথমবার ঢানঢানিয়ার বাড়িতে লাড়ু আর সরবত। লাড়ু আপনি বা হাতে খান। ব্যাপারটা দেখেছিলাম বটে, কিন্তু যাকে লক্ষ করা বলে তা করিনি। অর্থাৎ ওটার তাৎপর্য বুঝিনি। দ্বিতীয়বার, চায়ের দোকানে চায়ের সঙ্গে নানখাটাই খেলেন, তাও বাঁ হাতে। এটা আমার মনের কোণে নোট করে রেখেছিলাম। কাল চা বিস্কুট খেলেন আমাদের ঘরে, বিস্কুট বা হাতে। তখনই বুঝতে পারি আপনি ক্রিশ্চান। কিন্তু এবারও তাৎপর্য বুঝিনি। এখন বুঝেছি।
বহুৎ আচ্ছা। কিন্তু তাৎপর্যটা কী সেটা জানতে পারি? এই কথাটা বলতে আপনি একেবারে দুবরাজপুর চলে এলেন?
তা হলে আরেকটা প্রশ্ন করি?
করুন।
আপনার ফ্যামিলিতে প্রথম কে ক্রিশচীন হয়?
তাঁর নাম?
অনন্ত নারায়ণ।
তাঁর ছেলের নাম?
চার্লস প্ৰেমচাঁদ।
অ্যান্ড হিজ সন?
রিচার্ড শঙ্কর প্রসাদ।
তিনি কি আপনি?
ইয়েস স্যার।
আপনার ঠাকুরদাদার বাবার নাম কি হীরালাল?
হ্যাঁ-বাটি হাউ ডিড ইউ—?
চৌবের মুখ থেকে খুশি ভাৰটা চলে গিয়ে এখন খালি অবাক অবিশ্বাস।
এই হীরালালই কি রেজিমন্যান্ড ম্যাক্সওয়েলের পাংখা টানত?
এ খবর আপনি পেলেন কী করে?
একটা বই থেকে। পাদ্রি প্রিচার্ডের লেখা! যিনি আপনার ঠাকুরদাদাকে অনাথ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে তাকে ক্রিশচন করে তার ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন।
এরকম একটা বই আছে বুঝি?
আছে। দুষ্প্রাপ্য বই, কিন্তু আছে।
তা হলে তো আপনি–
কী?
আপনি তো জানেন…
কী জানি?
সেটা আপনিই বলুন মিঃ মিত্তির। আমার বলতে সংকোচ হচ্ছে।
বলছি, বলল ফেলুদা। আপনার প্রপিতামহর সাহেবের বুটের লাথি খেয়ে প্রাণত্যাগ করার ঘটনা। আপনি এখনও ভুলতে পারেননি। ছেলেবেলা থেকেই হয়তো শুনে এসেছেন রেজিন্যান্ড খ্যাঁকশেয়াল কী জাতীয় লোক ছিলেন। যখন আপনি জানলেন যে সেই রেজিন্যান্ডের নাতি এখানে এসেছে এবং যখন দেখলেন সেই নাতির মধ্যে রেজিন্যাল্ডের ঔদ্ধত্য। আর ভারতবিদ্বেষ পুরোপুরি বর্তমান, তখন—
ঠিক আছে, মিঃ মিত্তির, আর বলতে হবে না।
তা হলে আমি যা ভাবছি সেটাই ঠিক তো?
কী?
আপনি প্রতিহিংসাবশত টমকে মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করেন। পাথরটা নেন যাতে
সন্দেহটা ওই চারজনের উপর গিয়ে পড়ে।
ঠিক। এখন এর জন্য আমার কী শাস্তি হওয়া উচিত বলুন।
সেটাই আমি আপনাকে বলতে এসেছি।
কী?
আপনার কোনও শাস্তি হবে না। আপনার অবস্থায় পড়লে আমিও ঠিক এই জিনিসই
করতাম। আপনি গুরু পাপে লঘু দণ্ড দিয়েছেন। আপনি নিদোষ।
থ্যাঙ্ক ইউ, মিঃ মিত্তির-থ্যাঙ্ক ইউ।
এখন আপনার কোন চোখ নাচছে, মিঃ সর্বজ্ঞ গঙ্গোপাধ্যায়?
দুচোখই। একসঙ্গে। আনন্দের নাচনি। আমি কেবল ভাবছি। একটা কথা।
আমি জানি।
কী বলুন তো?
আপনার বন্ধু শতদল সেনকে ধন্যবাদ দিতে হবে, এই তো?
মোক্ষম ধরেছেন। তিনি বইটা না দিলে—
–এই মামলার নিম্পত্তি হত না-
আর জগন্নাথ চাটুজ্যে রয়ে যেতেন ক্রিমিনাল।
অন্তত আমাদের মনে।
ঠিক বলেছেন।
হরিপদবাবু-চলুন তো দেখি পিয়ার্সন পল্লী। শতদল সেনের বাড়ি।
*
রবার্টসনের রুবিটা শেষ পর্যন্ত মিউজিয়মেই গেল। কৃতিত্বটা যে ফেলুদার, সেটা বলাই বাহুল্য। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা যখন ম্যাক্সওয়েলের ভারতবর্ষে আসার ব্যয়ভার গ্রহণ করেছে, তা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে ও যথেষ্ট নাম-করা ফোটোগ্রাফার, এবং এই জাতীয় লোকের টাকার অভাব থাকার কথা নয়। আরও টাকার লোভে ও রুবিটা বিক্রি করতে চাইছিল। পিটার ম্যাক্সওয়েলের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হলেও ছাটবেলাকার বন্ধুত্বের কথা ভেবে ওর কথায় সরল বিশ্বাসে রুবিটা বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলেন। ফেলুদার কথায় তিনি পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির জন্য যা করতে এসেছিলেন তাই করলেন। ম্যাক্সওয়েলের রাগ ও আস্ফালন কোনও কিছুই তাঁকে টলাতে পারল না।