খুলে দেখি টম ম্যাক্সওয়েল-তর মুখ গম্ভীর। ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল টমের দিকে! টম মাথা নাড়ল।
আমি বসতে আসিনি।
আই সি।
আমি এসেছি তুমি এবং তোমার দুই বন্ধুর ঘর সার্চ করতে।
সার্চ তো কাল একবার করা হয়ে গেছে। তাতে তোমার বিশ্বাস হল না!
নো। সে সার্চ করেছে ইন্ডিয়ান পুলিশ। আমার তাদের ওপর কোনও বিশ্বাস নেই।
সার্চ করতে ওয়ারেন্ট লাগে তা জানো? যে কেউ সার্চ করতে চাইলেই সার্চ করতে পারে না।
তা হলে তুমি আমাকে সার্চ করতে দেবে না?
নো, মিঃ ম্যাক্সওয়েল। ও ব্যাপারটা কালই হয়ে গেছে। আজ আর হবে না।
ম্যাক্সওয়েল আর দ্বিরুক্তি না করে অ্যাবাউট টার্ন করে চলে গেল।
বোঝে, বললেন লালমোহনবাবু। আপনার সঙ্গে অনেক তদন্তেই অংশগ্রহণ করলুম, কিন্তু ক্রিমিন্যাল বলে সাসপিশন এই প্রথম পড়ল আমাদের উপর।
সব রকম অভিজ্ঞতাই হয়ে থাকা ভাল, তাই নয় কি?
তা বটে। তা আপনি কি স্রেফ ঘরে বসে তদন্ত করবেন। বেরোবেন না কোথাও?
দরকার হলে নিশ্চয়ই বেরোব। তবে এখনকার স্টেজটা হল চিন্তা করার স্টেজ, আর সেটা ঘরে বসেই সবচেয়ে ভাল হয়। অবিশ্যি তাই বলে আপনাদের ধরে রাখতে চাই না। আপনার স্বচ্ছন্দে বেরোতে পারেন। শান্তিনিকেতন এবং তার আশেপাশে এখনও অনেক কিছুই দেখতে বাকি আছে।
ভেরি ওয়েল। আমরা তা হলে একবার শতদলকে গিয়ে ধরি; ও বলছিল ওর আজ কোনও ক্লাস নেই। দেখি ও কী সাজেস্ট করে। আপনাকে বরং একটা জিনিস দিয়ে যাচ্ছি। –শতদলের দেওয়া সেই বই। সেই পাদ্রি প্রিচার্ডের লেখা। দারুণ বই মশাই। কাল রাত্তিরে শেষ করেচি। এই ম্যাক্সওয়েলের পূর্বপুরুষ সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাবেন। আর নীল চাষ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা হয়ে যাবে।
ফেলুদাকে বইটা দিয়ে আমি আর লালমোহনবাবু বেরিয়ে পড়লাম।
শতদলবাবু বললেন, চলো তোমাদের একটা খাঁটি গ্রাম দেখিয়ে নিয়ে আসি। গোয়ালপাড়া। আর তার পিছনেই আছে গুরুদেবের প্রিয় নদী কোপাই। এ দুটো না দেখলে শান্তিনিকেতন দর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
গ্রাম এর আগে যে দেখিনি তা নয়, তবে গোয়ালপাড়ার মতো খাঁটি গ্রামের চেহারা এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লালমোহনবাবুকে কবিতায় পেয়েছে। তাঁর প্রিয় কবি বৈকুণ্ঠ মল্লিকের একটা কবিতার খানিকটা অংশ আবৃত্তি করে ফেললেন–
বাংলার গ্রামে স্পন্দিছে মোর প্রাণ
সেই কবে দেখা-আজও স্মৃতি অম্লান
যেদিকে ফেরাও দৃষ্টি
মানুষ ও প্রকৃতি দুইয়ে মিলে দেখা কী অপরূপ সৃষ্টি!
কোপাই দেখেও সেই একই ব্যাপার। এটাতে বোঝা যায় যে বৈকুণ্ঠ মল্লিক শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন–
জীর্ণ কোপাই সর্পিল গতি
মন বলে দেখে–~মনোরম অতি
দুই পাশে ধান
প্রকৃতির দান
দুলে ওঠে সমীরণে,
বলে দেবে কবি
আঁকা রূবে ছবি
চিরতরে মোর মনে।
০৯. এক আশ্চর্য ঘটনা
বিকালে এক আশ্চর্য ঘটনা। ইনস্পেক্টর চৌবে পাঁচটা নাগাত এসে বললেন, কেস খতম্। যা ভেবেছিলাম। তাই। জগন্নাথ চাটুজ্যে নিয়েছিল পাথরটা। সার্চ করে কিছু পাওয়া যায়নি। অবশ্য, কিন্তু তারপর একটু পুলিশি চাপ দেওয়াতে সত্যিটা বেরিয়ে পড়ে—আর সেই সঙ্গে পাথরটাও। একটা ফুলের টবে পুঁতে রেখেছিল।
আপনি নিয়ে এসেছেন পাথরটা?
ন্যাচারেলি।
চৌবে পকেট থেকে পাথরটা বার করলেন। আবার নতুন করে সেটার ঝলমলে রং দেখে মনটা কেমন জানি হয়ে গেল।
আশ্চর্য! বলল ফেলুদা।
কেন?
লোকটাকে দেখে চোর বলে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু জখমকারী বলে যায় না। একেবারে ভেতো বাঙালি।
মানুষের চেহারা দেখে সব সময় তার ভেতরটা জাজ করা যায় না মিঃ মিত্তির।
সেটা অবশ্য আমার অভিজ্ঞতাই বলে।
তা হলে পাথরটাকে এবার স্বস্থানে চালান দিই?
চলুন।
আমরা চারজনে দশ নম্বর ঘরের দিকে রওনা দিলাম।
পিটার দরজা খুলল।
ওয়েল, মিঃ রবার্টসন, বললেন চৌবে, আই হ্যাভ এ লিট্ল গিফুট ফর ইউ।
হোয়াট?
চৌবে পকেট থেকে কৌটোটা বার করে পিটারের হাতে দিলেন।
পিটার ও টমের মুখ হাঁ।
বাট, হোয়্যার–হোয়্যার…?
সেটা না হয় আর নাই বললাম। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে সেটাই হল আসল কথা। মিঃ ম্যাক্সওয়েল নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে ভারতীয় পুলিশ বেশ করিৎকম। এবার অবিশ্যি তোমরা এটা নিয়ে কী করবে। দ্যাট ইজ আপ ঢুঁ ইউ। বিক্রি করতে পার, ক্যালকাটা মিউজিয়ামেও দিয়ে দিতে পার।
পিটার ও টম দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, দুজনেই এবার ধাপ করে খাটে বসে পড়ল। পিটার মৃদুস্বরে বলল, গুড শো। কনগ্র্যাচুলেশনস।
এবার তা হলে চলি? বললেন চৌবে।
আই ডোন্ট নো হাউ ঢুঁ থ্যাঙ্ক ইউ। বলল। টম ম্যাক্সওয়েল।
ডোনট্। তোমার মনে যে ধন্যবাদ দেবার প্রশ্নটা জেগেছে সেটাই বড় কথা। আমরা তাতেই খুশি।
কী মনে হচ্ছে মশাই? পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
কোথায় যেন গণ্ডগোল, বিড়বিড় করে বলল ফেলুদা।
আমি বলব কোথায় গণ্ডগোল? এই ফর দ্য ফাস্ট টাইম দারোগার কাছে হেরে গেলেন। ফেলুমিত্তির। সেইখানেই গণ্ডগোল।
উঁহু। তা নয়। মুশকিল হচ্ছে কী আমি বিশ্বাস করছি না। আমি হেরে গেছি।
ফেলুদা চুপ করে গেল। তারপর বলল, তোপ্সে-তুই এখন কিছুক্ষণ লালমোহনবাবুর ঘরে যা। আমি একটু একা থাকতে চাই।
লালমোহনবাবুর ঘরে গিয়ে বসতে ভদ্রলোক বললেন, আমার ভাল লাগছে না ভাই তপেশ। একটা সুযোগ এসেও কেমন যেন ফসকে গেল। তাই বোধহয় কাল বা চোখটা নাচছিল।