এক মিনিটের মধ্যে ফেলুদাকে আবার দেখলাম, সঙ্গে চোবে। তারা দ্রুত এগিয়ে গেল ডান দিকে।
কী ব্যাপার? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
সংক্ষেপে ম্যাক্সওয়েল বলে ফেলুদা আর চৌবে এগিয়ে গেল।
এবার আমরা ফেলুদা আর চীবেকে অনুসরণ করে দৌড় শুরু করলাম।
একটা গাছের ধরে গিয়ে ফেলুদা থামল। হাত দশেক দূরে একটা মশাল জ্বলছে। তাঁর আলোয় দেখলাম ম্যাক্সওয়েল মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার পাশে ঘাসের উপর লুটাচ্ছে তার ব্যাগ আর ফ্ল্যাশাসমেত ক্যামেরা।
ইজ হি ডেড? চৌবের প্রশ্ন।
না। অজ্ঞান। পালস আছে।
চৌবের কাছে দেখলাম একটা ছোট্ট টর্চ রয়েছে। সেটা জ্বলিয়ে টমের মুখের উপর ফেলতে টমের চোখের পাতাটা যেন নড়ে উঠল। ফেলুদা এবারটমের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল।
ম্যাক্সওয়েল। টম!
ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকার থেকে মশালের আলোয় ছুটে বেরিয়ে এল পিটার।
হোয়াটস দ্য ম্যাটার উইথ হিমা? ইজ হি ডেড?
না। অজ্ঞান, বললেন চৌবে। তবে জ্ঞান ফিরছে।
ইতিমধ্যে টম চোখ খুলেছে। তার মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত।
কোথায় লেগেছে তোমার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
টম কোনওরকমে হাত দিয়ে মাথার পিছনটা দেখিয়ে দিল।
এবার পিটার মাটি থেকে ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে সেটা খুলে ভিতরে হাত ঢোকাতে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
দ্য রুবি ইজ গান, ভারী গলায় বলল পিটার।
টমকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরা আবার নস্করের বাড়িতে ফিরে এলাম। রুবি উধাও শুনে নস্করের অবস্থা দেখবার মতো হয়েছিল। সে শ্লেষ মেশানো গলায় বলল, তোমরা যা চেয়েছিলে তাই হল। ভারতবর্ষের রুবি ভারতবর্ষেই ফিরে এল, তবে তোমাদের পৃথিবী ভ্ৰমণ আমার হল না।
পূৰ্বপল্লীর ডাক্তার সিংহ টমকে পরীক্ষা করে বললেন, মাথার পিছনের একটা অংশ ফুলেছে। কোনও ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করার ফলে টম সংজ্ঞা হারায়।
এই আঘাত থেকে মৃত্যু হতে পারত কি? পিটার জিজ্ঞেস করল।
আরেকটু জোরে হলে হতে পারত বইকী? বললেন ডাঃ সিংহ। আপাতত ওখানটায় বরফ ঘষে দেওয়া ছাড়া আর কোনও চিকিৎসা নেই। ব্যথা বেশি হলে একটা পেন। কিলার খেয়ে নিলে কাজ দেবে।
ডাঃ সিংহ চলে যাবার পর চৌবে মুখ খুললেন।
মিঃ ম্যাক্সওয়েল, আপনাকে যে আঘাত করেছে তাকে তো আপনি দেখতে পাননি বলে বললেন।
না। সে লোক আমার পিছন দিক দিয়ে আসে।
যতদূর বুঝতে পারছি, বললেন চৌবে, মাথার পিছনে বাড়ি মারার কারণ ওই পাথর চুরি করা। টম ম্যাক্সওয়েলের ব্যাগে এরকম একটা পাথর ছিল সেটা অনেকেই জানত না, যদিও রবার্টসনস রুবির কথা অনেকেই এর মধ্যে জেনে গেছে। যাঁরা টমের ব্যাগে পাথর আছে জানতেন তাঁরা হলেন আমি, মিস্টার মিত্তির, তাঁর ভাই, তাঁর বন্ধু লালমোহনবাবু, জগন্নাথ চাটুজ্যে, কিশোরীলাল এবং মিঃ নস্কর।
মিঃ নস্কর হা হাঁ করে উঠলেন। –পাথরটা তো আমার হাতে চলেই আসত; সেখানে আমি এ রাস্তা নেব কেন-যেখানে আমার বাড়ি খেয়ে টম খুনিও হয়ে যেতে পারত?
ও সব বলে লাভ নেই, মিঃ নস্কর। আপনি প্রাইম সাসপেক্ট। হিপূনোিটাইজড অবস্থায় মিঃ গাঙ্গুলী যা বলেছেন সেগুলো যে ফলবেই এমন কোনও গ্যারাস্টি নেই। এ রুবি যেমন তেমন রুবি নয়, আর আপনিও যেমন তেমন কালেক্টর নন। সে রুবি বৃহীত হয়ে যেতে পারে জেনে আপনি সেটা বিনা পয়সায় হাত করার চেষ্টা করবেন না? কী বলছেন। আপনি?
ননসেন্স! ননসেন্স! বলে নস্কর চুপ করে গেলেন।
চৌবে বলে চললেন, এ ছাড়া আছে কিশোরীলাল। তার বাপ পয়সা দিয়ে জিনিসটা কিনতে চেয়েছিলেন। তাতে ছেলের কোনও লাভ হত না। অথচ ছেলে রুবির মূল্য জানে, সেটা কোথায় থাকে তা জানে। এই অবস্থায় সেটাকে হাতাবার চেষ্টা করাটা কি খুব অস্বাভাবিক?..টমের উপর আক্রোশ ছিল এমন এক ব্যক্তি ওখানে উপস্থিত ছিলেন। সে হল চাঁদু মল্লিক। মাথায় বাড়ি মারাটা চাঁদুর পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক, কারণ সে বদলা নেবে। বলে শাসিয়েই রেখেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, সে কি রুবিয়া ব্যাপারটা জানত? মনে তো হয় না। এখানে টমকে মাথায় আঘাত মেরে অজ্ঞান করে স্রেফ টাকাকড়ির লোভে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে যদি ঘটনাচক্রে রুবির কৌটোটা পেয়ে যায়—এই সম্ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না, পারি কি?… আরেকজন সাসপেক্ট হচ্ছে জগন্নাথ চাটুজ্যে। ইনি রুবি সম্বন্ধে জানতেন, কোথায় সেটা থাকে তাও জানতেন। ওঁর এ হেন আচরণের কারণ একমাত্র লোভ।
ফেলুদা বলল, একজন সাসপেক্টকে আপনি বাদ দিয়ে যাচ্ছেন, মিঃ চৌবে।
কে?
পিটার রবার্টসন।
হোয়াট! বলে লাফিয়ে উঠল। পিটার।
ইয়েস মিঃ রবার্টসন! বলল ফেলুদা। তুমি চেয়েছিলে রুবিটকে কলকাতার মিউজিয়ামের হাতে তুলে দিতে। তোমার বন্ধু তাতে বাদ সাধছিল। পাছে বিদেশে এসে বন্ধু-বিচ্ছেদ হয় তাই তুমি পাথরটা বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলে। কিন্তু শেষে তোমার মত পালটানো আশ্চর্য নয়। এমনিতেও টমের সঙ্গে তোমার আর সীহাদ্যের সম্পর্ক ছিল না। আমি যদি বলি যে তুমি তোমার মূল সিদ্ধান্তে ফিরে গিয়েছিলে, এবং তাই পাথরটা নিজের কাছে নিয়ে আস।
কথাগুলো শুনে রবার্টসন কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সটান উঠে দাঁড়িয়ে হাত দুটো মাথায় তুলে বলল, আমি নিয়েছি কি না জানার খুব সহজ। রাস্ত আছে। সার্চ মি, ইন্সপেক্টর চৌবে। রুবি নিয়ে থাকলে এর মধ্যে সেটা সরাবার কোনও সুযোগ আমি পাইনি। কাম অন, ইন্সপেক্টর-সার্চ মি।