ভিড়ের মধ্যে থেকে দেখি ইন্সপেক্টর চৌবে বেরিয়ে এলেন।
শুধু আমি নয়, বললেন চীবে, আপনাদের অনেক পরিচিত ব্যক্তিই এখানে উপস্থিত।
কী রকম? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
কিশোরীলাল আর চাঁদু মল্লিককেও দেখলাম। সেই বীরভূম বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিও রয়েছেন।
সে তো ভাল কথা। নাচটা আরম্ভ হবে কখন?
সব লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়েছে তো। যে কোনও মুহূর্তেই শুরু হবে।
পিটারকে দেখে ফেলুদা এগিয়ে গিয়ে বলল, কাছাকাছির মধ্যে থেকে, না হলে ফেরার সময় খুঁজে বার করা মুশকিল হবে।
টম ম্যাক্সওয়েল ক্যামেরা বার করে তাতে ফ্ল্যাশ লাগাচ্ছে। নস্করকে দেখুলাম তিনিও একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাশ ক্যামেরা নিয়ে রেডি। তিনি টমের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফোটোগ্রাফি সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করলেন। আমি কাছেই ছিলাম, তাই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম। নস্কর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি স্টুডিয়ো আছে?
না, বলল। টম ম্যাক্সওয়েল। আমি স্টুড়িয়ে ফেটাগ্রাফার নই। আমি দেশ-বিদেশে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলি। ফ্রি ল্যান্স। আমার ছবি বহু পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে। ভারতবর্ষে যা ছবি তুলিব তা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন নেবে বলেছে। তারাই আমার খরচ বহন করছে।
মাদলে চাঁটি পড়ল। টমের সঙ্গে আমরাও নাচের দলের দিকে এগিয়ে গেলাম।
নাচ শুরু হয়ে গেছে। জনা তিরিশেক সাজগোজ করা মেয়ে পরস্পরের হাত ধরে দুলতে শুরু করেছে। তিনটে মাদলের সঙ্গে তিনজন বংশীবাদক রয়েছে। মাদল যারা বাজাচ্ছে তাদের পায়ে ঘুঙুর।
লালমোহনবাবু আমার পাশে এসে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন, এখন আবার বাঁ। চোখটা নাচছে। কপালে কী আছে কে জানে।
হিপূনোটাইজড হয়ে শরীর খারাপ হয়নি তো?
নাঃ। অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, জানো ভাই তপেশ। কী যে করেছি। আর কী যে বলেছি তার কিছু মনে নেই।
এবার মশালের আলোয় হঠাৎ চাঁদু মল্লিককে দেখতে পেলাম বিড়ি কুঁকছে। এক পা এক পা করে সে নাচের দলের দিকে এগোচ্ছে।
না, নাচের দিকে নয়, টমের দিকে।
আমি লালমোহনবাবুকে ফিসফিসিয়ে বললাম, ওকে চোখে চোখে রাখা দরকার।
যা বলেছি।
টম কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। সে এবার পিছন দিকে চলে গেল, বোধহয় নতুন দৃষ্টিকোণ খোঁজবার জন্য। সব ফেটাগ্রাফারই কি এই রকম ছটফটে হয়?
চাঁদু মল্লিক একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার দু হাত সরু প্যান্টের পকেটে গোঁজা।
ক্রমে আমাদের দলের লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। লালমোহনবাবু অবশ্য আমার পাশ ছাড়েননি। আমি বাকি সকলের উপর দৃষ্টি রাখতে চেষ্টা করছিলাম, কারণ ফেরার সময় সকলকে এক জায়গায় জড়ো হতে হবে। ওই যে ফেলুদা, চৌবেকে একটু আগে ওর। পাশে দেখেছিলাম, এখন আর নেই। ওই যে নস্কার-ওঁর ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠিল। অলস ছন্দে নাচ হয়ে চলেছে।
ওই কিশোরীলাল। সে পিটারের দিকে এগোচ্ছে। ওদের মধ্যে কিছু কথা হয় কি না। জানিবার জন্য আমি জটায়ুকে ছেড়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম।
কিশোরীলাল পিটারকে সামনে পেয়ে বলল, গুড ইভনিং।
পিটার বলল, কালকে আমাদের অ্যাপিয়েন্টমেন্টটা ঠিক আছে তো?
ইয়েস স্যার।
আশা করি তোমার বাবা মত বদলাবেন না।
নো স্যার। হি হ্যাঁজ মেড আপ হিজ মাইন্ড।
ভেরি গুড।
কিশোরীলাল চলে গেল।
এবার জগন্নাথবাবুকে দেখলাম তাঁর জায়গা নিতে। পিটার হ্যালো বলে বলল, আমাকে এই নাচের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দেবে?
সার্টেন্লি।
জগন্নাথবাবু পিটারের পাশে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে নাচের ব্যাপারটা. বোঝাতে আরম্ভ করল। আমি আর শুনতে না পেয়ে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে গেলাম।
এবার ফেলুদাকে দেখলাম একটা মশালের আলোয়। সে একটা চারমিনার ধরাল।
প্ৰথম নাচ শেষ হয়ে দ্বিতীয় নাচ শুরু হল। এর তাল একেবারে অন্য, আগেরটার চেয়ে অনেক দ্রুত। মেয়েরা একবার নিচু হচ্ছে পরস্পরের হাত ধরে, তার পরেই সোজা হয়ে উঠছে, তালে তালে, মাদল আর বাঁশির সঙ্গে। সেই সঙ্গে একটানা সুরে গান। ভেরি এক্সাইটিং মন্তব্য করলেন জটায়ু।
আমাদের সামনে দিয়ে মিঃ নস্কর ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন আমাদের দিকে একটা প্রশ্ন ছড়ে দিয়ে— কেমন লাগছে?
কী ব্যাপার? এমন জোর নাচ চলেছে আর আপনার কপালে খাঁজ?
প্রশ্নটা জটায়ু করলেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসা ফেলুদাকে।
ভ্রূকুটির কারণ আছে। পরিবেশটা ভাল নয়, ভাল নয়। —ম্যাক্সওয়েলকে দেখেছিস, তোপ্সে?
কিছুক্ষণ আগেও দেখেছি, কিন্তু এখন আর দেখছি না।
ছাকরা গেল কোথায়? বলে আমাদের ছেড়ে ফেলুদা বা দিকে এগিয়ে গেল।
লালমোহনবাবু বললেন, তোমার দাদাকে হেলপ করবে? চলো আমরাও গিয়ে দেখি ম্যাক্সওয়েল গেল কোথায়।
চলুন।
লালমোহনবাবুর হাত ধরে এগিয়ে গেলাম নাচের দলের পিছন দিকটায়। চাঁদু মল্লিক। কিশোরীলাল। এক ঝলক এক ঝলক দেখছি। একেকটা চেনা মুখ। কিন্তু টম কই?
ওই যে পিটার। সেও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভ্রূকুটি করে এদিক ওদিক দেখছে।
হ্যাভ ইউ সিন টম?
আমরাও ওকেই খুঁজছি।
আই ভেন্ট লাইক দিস অ্যাট অল।
পিটার টমকে খুঁজতে ডাইনে চলে গেল। আমরা বাঁয়ে এগিয়ে গেলাম। নাচ এখন আরও দ্রুত, মাদল বেজে চলেছে। নীচের দল গাইছে, দুলছে আর ঘুরছে।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে ফেলুদা বেরিয়ে এল।
চৌবেকে দেখেছিস?
সে গম্ভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে এগিয়ে গেল। দুবার তাকে গলা তুলতে শুনলাম।
ইন্সপেক্টর চৌবে! ইন্সপেক্টর চৌবে।