একা মানুষের পক্ষে তো আপনার বিরাট বাড়ি দেখছি, বলল ফেলুদা।
একা বটেই, তবে আমার বন্ধু-বান্ধব অনেক! তাদের চার-পাঁচজনকে ধরে নিয়ে প্রায়ই এখানে ছুটি কাটিয়ে যাই।
নস্কর আর দুই সাহেবের জন্য হুইস্কি এল, আর আমরা ও রসে বঞ্চিত জেনে আমাদের জন্য লিমকা।
লালমোহনবাবুর দিকে দৃষ্টি দিয়ে হঠাৎ নস্কর বললেন, আপনার বন্ধু যে গোয়েন্দা সে আমি নাম শুনেই বুঝেছি। কিন্তু আপনার সঠিক পরিচয়টা পাওয়া যায়নি। এখন জিজ্ঞেস করতে পারি কি?
উত্তর দিল ফেলুদা।
ওর আসল নামটা অনেকেই জানে না। উনি ছদ্মনামে থ্রিলার লেখেন। সেই নামটা হল। জটায়ু। জনপ্রিয়তায় উনি নাম্বার ওয়ান বললে বেশি বলা হবে না।
ঠিক, ঠিক-আমি পড়েছি আপনার লেখা। সাংঘাইয়ে সংঘাত—কেমন, ঠিক বলিনি?
লালমোহনবাবু একটা বিনয়ী হাসি হাসলেন।
আমি সিরিয়াস বই একদম পড়তে পারি না, বললেন নস্কর। বিলিতি ক্রাইম ফিকশন পড়ি আর মাঝে মাঝে দু-একটা দিশিও চোখে দেখি। এখন কী লিখছেন?
আপাতত রেস্ট। গত পুজোয় একটা বেরিয়েছে। নাম শুনে থাকতে পারেন—– লন্ডনে লণ্ডভণ্ড।
এটাও কি হিট?
সাড়ে চার হাজার কপি নিঃশেষ। –হেঃ হেঃ।
মিঃ নস্কর আসল প্রসঙ্গে যেতে রেশি সময় নিলেন না। পিটারের দিকে ফিরে বললেন, আমার প্রস্তাবটা নিয়ে কি আপনি কিছু ভেবেছেন?
আমি পাথরটা বিক্রি করে দিচ্ছি। বলাল পিটার।
দ্যাট্স এক্সেলেন্ট।
কিন্তু আপনাকে না।
ঢানঢানিয়া?
হ্যাঁ। উনিই প্রথম আফার দিয়েছিলেন। তাই….?
নো, মিঃ রবার্টসন, আপনি ওটা আমাকেই বিক্রি করবেন।
সে কী করে হয়? আই হ্যাভ সেট-আপ মাই মাইন্ড।
কী করে হয় আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। কারণটা আমি একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির মুখ দিয়ে শুনিয়ে দিচ্ছি। –মিঃ গাঙ্গুলী!
আগ-গেঁ?
ডাকটা এত অপ্রত্যাশিত যে লালমোহনবাবুর গলা চিরে দু-ভাগ হয়ে গেল।
আপনি কাইন্ডলি যদি এই কাপোটের সামনেটায় এসে দাঁড়ান।
আ-আমি?
আপনিই সবচেয়ে নিরপেক্ষ এবং সবচেয়ে অমায়িক। আপনি ভয় পাবেন না। আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। আমার একটা বিশেষ ক্ষমতার কথা আপনাদের বলা হয়নি। আমি সকলকে হিপনোটাইজ করতে পারি। সেই অবস্থায় তাদের নানারকম প্রশ্ন করে সঠিক জবাব পেতে পারি। হিপূনোিটাইজড ব্যক্তি কখনও মিথ্যা বলে না। কারণ সেই ক্ষমতাটা তাদের সাময়িকভাবে লোপ পেয়ে যায়। সেই জায়গায় নতুন ক্ষমতা আসে। সেটার, পরিচয় আপনারা এখনই পাবেন।
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে লালমোহনবাবু আপত্তি করার কোনও সুযোগই পেলেন। না! ফেলুদাও দেখলাম নির্বিকার। আসলে লালমোহনবাবুকে নিয়ে কেউ রগড় করলে ও সেটা বেশ উপভোগ করে।
নস্কর উঠে গিয়ে লালমোহনবাবুর কাঁধ ধরে তাঁকে একরকম টেনে এনেই ঘরের মাঝখানে দাঁড় করালেন। তারপর নিজেই গিয়ে ঘরের বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট্ট লাল টর্চ বার করে সেটা জ্বলিয়ে জটায়ুর চোখের উপর ফেলে আলোটাকে ঘোরাতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে তার কথাও শুরু হল।
আপনি সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভর করুন, আমার উপর নির্ভর করুন। আপনার নিজের সত্তা লোপ পেতে বসেছে, সেই জায়গায় আসছে একটি অলীকিক শক্তিসম্পন্ন বিজ্ঞ মানুষ। …ইয়েস… ইয়েস… ইয়েস… ইয়েস…
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লালমোহনবাবুর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে, তাঁর মুখ হাঁ হয়ে আসছে। তিনি সটান চেয়ে আছেন নস্করের দিকে।
এবার টর্চ ঘোরানো থামল, কিন্তু নস্কর সেটা লালমোহনবাবুর মুখের উপর ফেলে রাখলেন। তারপর এল প্রথম প্রশ্ন।
আপনার নাম কী?
শ্ৰী সৰ্বজ্ঞ গঙ্গোপাধ্যায়, ওরফে লালমোহন, ওরফে জটায়ু।
লালমোহনবাবুর এ নাম আমি কখনও শুনিনি।
এ ঘরে কজন উপস্থিত আছে?
ছয় জন।
তাদের সবাই কি বাঙালি?
দুজন সাহেব।
তাদের নাম কী?
পিটার রবার্টসন। আর টম ম্যাক্সওয়েল।
তাঁরা কোথেকে আসছেন?
ল্যাঙ্কেশিয়ার, ইংল্যান্ড।
এঁদের বয়স কত?
পিটার চৌত্ৰিশ বছর তিন মাস, টম তেত্রিশ বছর নয় মাস।
এঁদের ভারতবর্ষে আসার উদ্দেশ্য কী?
পিটারের উদ্দেশ্য রবার্টসনের রুবি দেরত দেওয়া।
সে রুবি কার কাছে আছে?
টিম ম্যাক্সওয়েল।
এই রুবির ভবিষ্যৎ কী?
ওটা বিক্রি হবে।
সেটা কি গণেশ ঢানঢানিয়া কিনবে?
না।
কিন্তু উনি তো দর দিয়েছেন?
এবার দশ লাখ নেমে হবে সাড়ে সাত।
তার মানে পিটার বিক্রি করবে না?
না।
তা হলে?
ওটা অন্য একজন কিনবেন?
কে?
অর্ধেন্দু নস্কর।
কত দাম?
বারো লাখ।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।
এবার নস্কর লালমোহনবাবুর কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিতেই তিনি ধড়মড়িয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন।
ওয়েল মিস্টার রবার্টসন?
নস্কর পিটারের দিকে চেয়ে প্রশ্নটা করলেন।
দ্যাট ওয়জ মোস্ট ইমপ্রেসিভ।
এখন বিশ্বাস হল?
আই ডোন্ট নো হোয়াট ঢু থিঙ্ক।
তোমাকে ভাবতে হবে না। তাড়া নেই। তুমি ঢানঢানিয়ার সঙ্গে কাল দেখা করে। সাড়ে সাত লাখে তোমার রুবি বিক্রি করতে চাও তো পার। তা না হলে আমার বারো লাখের অফার তো রয়েইছে।
চাকর এসে খবর দিল ডিনার রেডি।
আমরা সকলে উঠে ডাইনিং রুমের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
০৭. ষোড়শোপচারে ডিনার
ষোড়শোপচারে ডিনার সেরে আমরা সোয়া দশটা নাগাত ফুলবেড়িয়া গ্রামে হাজির হলাম। পূর্ণিমা রাত, তা ছাড়া এখানে ওখানে মশাল জ্বলছে, তাই দেখার কোনও অসুবিধা নেই। গ্রামের একপাশে একটা মাঠ, সেখানেই লোকের ভিড়। এরা সাঁওতাল নয়–বেশির ভাগই শহরের লোক, নাচ দেখতে এসেছে। তাদের মধ্যে মেয়ে-পুরুষ দুইই রয়েছে।