আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন?
হ্যাঁ।
আমার নাম করেছিলেন?
বেয়ারা তাতেও বলল হ্যাঁ।
তাজ্জব ব্যাপার!
হঠাৎ কী মনে করে ধীরুকাকা ঝড়ের মতো শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর গোদরেজ আলমারি খোলার শব্দ পেলাম। আর তার পরেই শুনলাম ধীরুকাকার চিৎকার—
সর্বনাশ!
বাবা, আমি আর ফেলুদা প্রায় একসঙ্গে হুড়মুড় করে ধীরুকাকার ঘরে ঢুকলাম।
গিয়ে দেখি উনি আংটির কৌটোটা হাতে নিয়ে চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে আছেন।
কৌটোর ঢাকনা খোলা, আর তার ভিতরে আংটি নেই।
ধীরুকাক কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে ধপ করে তাঁর খাটের উপর বসে পড়লেন।
০৪. পরদিন সকালে
পরদিন সকালে মনে হল যে শীতটা একটু বেড়েছে, তাই বাবা বললেন গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে নিতে। বাবার কপালে ভ্রূকুটি আর একটা অন্যমনস্ক ভাব দেখে বুঝতে পারছিলাম যে উনি খুব ভাবছেন। ধীরুকাকাও কোথায় জানি বেরিয়ে গেছেন—আর কাউকে কিছু বলেও যাননি। কালকের ঘটনার পর থেকেই কেবল বললেন—শ্ৰীবাস্তবকে মুখ দেখাব কী করে? বাবা অবিশ্যি অনেক সাস্তুনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। বিকেল বেলা সন্ন্যাসী সেজে চোর এসে তোমার বাড়ি থেকে আংটি নিয়ে যাবে সেটা তুমি জানবে কী করে। তার চেয়ে তুমি বরং পুলিশে একটা খবর দিয়ে দাও। তুমি তো বলছিলে ইনস্পেক্টর গরগরির সঙ্গে তোমার খুব আলাপ আছে। এও হতে পারে যে ধীরুকাকা হয়তো পুলিশে খবর দিতেই বেরিয়েছেন।
সকালে যখন চা আর জ্যামরুটি খাচ্ছি, তখন বাবা বললেন, ভেবেছিলাম আজ তোদের রেসিডেন্সিটা দেখিয়ে আনব, কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে আজকের দিনটা যাক। তোরা দুজনে বরং কোথাও ঘুরে আসিস কাছাকাছির মধ্যে।
কথাটা শুনে আমার একটু হাসিই পেয়ে গেল, কারণ ফেলুদা বলছিল ওর একটু পায়ে হেঁটে শহরটা দেখার ইচ্ছে আছে, আর আমিও মনে মনে ঠিক করেছিলাম ওর সঙ্গে যাব। আমি জানতাম শুধু শহর দেখা ছাড়াও ওর অন্য উদ্দেশ্য আছে। আমি সন্ধেবেলা থেকেই দেখছি ওর চোখের দৃষ্টিট মাঝে মাঝে কেমন জানি তীক্ষ হয়ে উঠছে।
আটটার একটু পরেই আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম।
গেটের কাছাকাছি এসে ফেলুদা বলল, তোকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি—বক্ বক্ করলে বা বেশি প্রশ্ন করলে তোকে ফেরত পাঠিয়ে দেব। বোকা সেজে থাকবি, আর পাশে পাশে হাটবি।
কিন্তু ধীরুকাক যদি পুলিশে খবর দেন?
তাতে কী হল?
ওরা যদি তোমার আগে চোর ধরে ফেলে?
তাতে আর কী? নিজের নামটা চেঞ্জ করে ফেলব।
ধীরুকাকার বাড়িটা যে রাস্তায় সেটার নাম ফ্রেজার রোড। বেশ নির্জন রাস্তাটা। দুদিকে গেট আর বাগান-ওয়ালা বাড়ি, তাতে শুধু যে বাঙালিরা থাকে তা নয়। ফ্লেজার রোডটা গিয়ে পড়েছে ডাপলিং রোডে, লখ্নৌতে একটা সুবিধে আছে—রাস্তার নামগুলো বেশ বড় বড় পাথরের ফলকে লেখা থাকে। কলকাতার মতো খুঁজে বার করতে সময় লাগে না।
ডাপ্লিং রোডটা যেখানে গিয়ে পার্ক রোডে মিশেছে, সেই মোড়টাতে একটা পানের দোকান দেখে ফেলুদা হেলতে দুলতে সেটার সামনে গিয়ে বলল, মিঠা পান হ্যায়?
মিঠা পান? নেহি, বাবুজি। লেকিন মিঠা মাসাল্লা দেকে বানা দেনে সেকতা।
তাই দিজিয়ে। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, বাংলা দেশ ছাড়লেই এই একটা প্রবলেম।
পানটা কিনে মুখে পুরে দিয়ে ফেলুদা বলল, হ্যাঁ ভাই, আমি এ-শহরে নতুন লোক। এখানকার রামকৃষ্ণ মিশনটা কোথায় বলতে পার?
ফেলুদা অবিশ্যি হিন্দিতে প্রশ্ন করছিল, আর লোকটাও হিন্দিতে জবাব দিয়েছিল, কিন্তু আমি বাংলাতেই লিখছি।
দোকানদার বলল, রামকিষণ মিসির?
রামকৃষ্ণ মিশন। শহরে একজন বড় সাধুবাবা এসেছেন, আমি তাঁর খোঁজ করছি। শুনলাম তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে উঠেছেন।
দোকানদার মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে কী জানি বলে বিড়ি বাঁধতে আরম্ভ করে দিল। কিন্তু দোকানের পাশেই একটা খাটিয়ায় একটা ইয়াবড় গোঁফওয়ালা লোক একটা পুরনো মরচে ধরা বিস্কুটের টিন বাজিয়ে গান করছিল, সে হঠাৎ ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করল, কালো গোঁফদাড়িওয়ালা কালো চশমা পরা সাধু কি? তাই যদি হয় তা হলে তাকে কাল সন্ধেবেলা টাঙ্গার স্ট্যান্ড কোথায় বলে দিয়েছিলাম।
কোথায় টাঙ্গার স্ট্যান্ড?
এখান থেকে পাঁচ মিনিট। ওই দিকে প্রথম চৌমাথাটায় গেলেই সার সার গাড়ি দাঁড়ানো আছে দেখতে পাবেন।
শুক্রিয়া!
শুক্রিয়া কথাটা প্রথম শুনলাম। ফেলুদা বলল ওটা হল উর্দুতে থ্যাঙ্ক ইউ।
টাঙ্গা স্ট্যান্ডে পৌঁছে সাতটা টাঙ্গাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করার পর আট বারের বার সাতান্ন নম্বর গাড়ির গাড়োয়ান বলল যে গতকাল সন্ধ্যায় একজন গেরুয়াপরা দাড়িগোঁফওয়ালা লোক তার গাড়ি ভাড়া করেছিল বটে।
কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে সাধুবাবাকে?—ফেলুদা প্রশ্ন করল।
গাড়োয়ান বলল, ইস্টিশান।
স্টেশন?
হাঁ।
কত ভাড়া এখান থেকে?
বারো আনা।
কত টাইম লাগবে পৌঁছুতে?
দশ মিনিটের মতো।
চার আনা বেশি দিলে আট মিনিটে পৌঁছে দেবে?
টিরেন পাকাড়ন হ্যায় কেয়া?
টিরেন বলে টিরেন। বঢ়িয়া টিরেন—বাদশাহী এক্সপ্রেস!
গাড়োয়ান একটু বোকার মতো হেসে বলল, চলিয়ে—আট মিনিটমে পৌঁছা দেঙ্গে!
গাড়ি ছাড়বার পর ফেলুদাকে একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সেই সাধুবাবা কি এখনও বসে আছেন স্টেশনে আংটি নিয়ে?
এটা বলতে ফেলুদা আমার দিকে এমন কট্মটু করে চাইল যে আমি একেবারে চুপ মেরে গেলাম।
কিছুক্ষণ যাবার পর ফেলুদা গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করল, সাধুবাবার সঙ্গে কোনও মালপত্তর ছিল কি?