এই শেষ কথাটা শুনে আমি প্রথমে ধীরুকাকার দিকে, তারপর ফেলুদার দিকে চাইলাম। বনবিহারীবাবু কি তা হলে শ্রীবাস্তবের বাড়ির ঘটনাটা জানেন না?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, কারণ বনবিহারীবাবুর বেয়ারা কফি আর মিষ্টি এনে দেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীবাস্তব এসে হাজির হলেন।
সকলকে নমস্কার-টমস্কার করে ধীরুকাকাকে বললেন, আপনাদের বাড়ির কাছেই কেলভিন রোডে একটি ছেলে গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে। তাকে দেখে আপনার বাড়ি গিয়ে দেখি আপনারা ফেরেননি। তাই এখানে চলে এলাম।
ধীরুকাক শ্রীবাস্তবের দিকে চোখ দিয়ে একটা ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁর আংটি ঠিকই আছে।
বনবিহারীবাবুর সঙ্গে দেখলাম শ্ৰীবাস্তবের যথেষ্ট আলাপ। ছোট শহরে পাড়ার লোকেদের পরস্পরের মধ্যে আলাপটা বোধহয় সহজেই হয়।
শ্রীবাস্তব ঠাট্টার সুরে বললেন, বনবিহারীবাবু, আপনার পাহারাদারেরা কিন্তু আজকাল ফাঁকি দিচ্ছে।
বনবিহারীবাবু একটু অবাক হয়েই বললেন, কী রকম?
কাল আমার বাড়িতে চোর এল, আর আপনার একভি জানোয়ার কিছু সাড়াশব্দ করল না!
সে কী? চোর? আপনার বাড়িতে? কখন?
রাত তিনটের কাছাকাছি। নেয়নি কিছুই। ঘুমটা ভেঙে গেল আমার, তাই পালিয়ে গেল।
না নিলেও—খুব এক্সপার্ট বলতে হবে। আমার বাদশা অন্তত খুবই সজাগ। দুশো গজের মধ্যে আপনার বাড়ি—আর চোর এলেও আমার কম্পাউন্ডের পিছন দিয়েই তাকে যেতে হবে।
যাক গে! আপনাকে ঘটনাটা জানিয়ে রাখলাম।
কফির সঙ্গে একরকম মিষ্টি দিয়ে গিয়েছিল প্লেটে। শ্রীবাস্তব বললেন সেটার নাম সান্ডিলা লাডু।
সান্ডিলা লাডু, গুলাবি রেউরি, আর ভুনা পেড়া—এই তিন মিষ্টি হল লখ্নৌয়ের স্পেশালিটি।
আমার নিজের মিষ্টি জিনিসটা খুব ভাল লাগে না, তাই আমি ও সব কথায় বিশেষ কান না দিয়ে বনবিহারীবাবুকে লক্ষ করছিলাম। ওঁকে যেন একটু অন্যমনস্ক মনে হচ্ছিল। ফেলুদা কিন্তু দেখি এর মধ্যেই দুটো লাড়ু শেষ করে নিয়ে, আমার কফির পেয়ালার উপর মাছি তাড়াবার মতো করে হাত নাড়িয়ে দারুণ কায়দায় আমার প্লেট থেকে আরেকটা লাড়ু তুলে নিল।
বনবিহারীবাবু হঠাৎ শ্রীবাস্তবের দিকে ফিরে বললেন, আপনার সেই বাদশাহী আংটি ঠিক আছে তো?
শ্রীবাস্তবের হঠাৎ বিষম লেগে গেল। তারপর কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে কাশিটাকে হাসিতে চেঞ্জ করে বললেন—ও বাবা—আপনার দেখি মনে আছে?
বনবিহারীবাবু পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, মনে থাকবে না! আমার যদিও ও সব ব্যাপারে কোনও ইন্টারেস্ট নেই, তবুও ওরকম আংটি তো সচরাচর দেখা যায় না।
শ্ৰীবাস্তব বললেন, আংটি ঠিকই আছে। ওর ভ্যালু আমার জানা আছে।
বনবিহারীবাবু এবার হঠাৎ উঠে পড়ে বললেন, এক্সকিউজ মি—আমার বেড়ালের খাবার সময় হয়ে গেছে।
এ কথার পর আর থাকা যায় না—তাই আমরাও উঠে পড়লাম।
বাইরে এসে একজন লোককে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বনবিহারীবাবুর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখলাম। তার যে দারুণ মাসল সেটা গায়ে জামা থাকলেও বোঝা যায়। শুনলাম তার নাম নাকি গণেশ গুহ। বনবিহারীবাবুর যখন জানোয়ার চালান দেবার কারবার ছিল তখন থেকেই নাকি ইনি আছেন; এখন নাকি চিড়িয়াখানা দেখাশোনা করেন।
বনবিহারীবাবু বললেন, গণেশকে ছাড়া আমার চিড়িয়াখানা মেনটেন করা হত না। ওর ভয় বলে কোনও বস্তুই নেই। একবার ওয়াইল্ড ক্যাটের আচড় খাওয়া সত্ত্বেও ও আমার চাকরি ছাড়েনি।
আমরা যখন গাড়িতে উঠছি তখন বনবিহারীবাবু বললেন, আপনারা আসাতে খুব ভাল লাগল। মাঝে মাঝে এসে পড়বেন না হয়! এখন এখানেই আছেন তো?
বাবা বললেন, কদিন আছি। তারপর ভাবছি এদের একবার হরিদ্বারটা দেখিয়ে আনব।
বটে? লছমনঝুলা থেকে একটা বারো ফুট পাইথনের খবর এসেছে। আমিও তাই একবার ওদিকটায় যাব যাব করছিলাম।
শ্রীবাস্তবকে আমরা ওঁর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলাম। ঠিক সেই সময় বনবিহারীবাবুর বাড়ির দিক থেকে একটা বিকট চিৎকার শুনতে পেলাম।
ফেলুদা একটা হাই তুলে বলল, হাইনা।
বাপরে!—একেই বলে হাইনার হাসি।
শ্ৰীবাস্তব বললেন তাঁর নাকি প্রথম প্রথম এই হাসি শুনে গা ছমছম করত, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।
আপনার বাড়িতে কাল আর কোনও উপদ্রব হয়নি তো? ধীরুকাকা প্রশ্ন করলেন।
শ্রীবাস্তব হেসে বললেন, নো, নো। নাথিং।
আমরা যখন বাড়িতে ফিরলাম তখন প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে শুনতে পেলাম দূর থেকে একটা ঢাক-ঢোলের শব্দ আসছে। ধীরুকাক বললেন, দেওয়ালির সময় এখানে রামলীলা হয়। এটা তারই প্রিপারেশন হচ্ছে।
আমি বললাম রামলীলা কী রকম?
প্রায় দশটা মানুষের সমান উচু একটা রাবণ তৈরি করে তার ভিতর বারুদ বোঝাই করা হয়। তারপর দুজন ছেলেকে মেকআপ-টেকআপ করে রাম লক্ষ্মণ সাজায়। তারা রথে চড়ে এসে তীর দিয়ে রাবণের দিকে তাগ করে মারে—আর সেই সঙ্গে রাবণের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর গা থেকে তুবড়ি হাউই চরকি রংমশাল ছড়াতে ছড়াতে রাবণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সে একটা দেখবার জিনিস।
বাড়িতে ঢুকতে বেয়ারা শ্ৰীবাস্তবের আসার খবরটা দিল। তারপর বলল, আউর এক সাধুবাবা ভি আয় থা। আধঘণ্টা বইঠকে চলা গিয়া।
সাধুবাবা?
ধীরুকাকার ভাব দেখে বুঝলাম উনি কোনও সাধুবাবাকে এক্সপেক্ট করছিলেন না।
কোথায় বসেছিলেন?
বেয়ারা বলল, বৈঠকখানায়।