এর মধ্যেই ভুলে যাব?
সেই সময় এই গেটের কাছে কেউ থেকে থাকলে তার পক্ষে ঘটনাটা দেখে ফেলা অসম্ভব নয়।
এই রে। কিন্তু কেউ যে ছিল সেটা তুমি ভাবছ কেন?
ফেলুদা নিচু হয়ে নুড়ি পাথরের উপর থেকে একটা ছোট্ট জিনিস তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিল। হাতে নিয়ে দেখলাম সেটা একটা সিগারেটের টুকরো।
মুখটা ভাল করে লক্ষ কর।
আমি সিগারেটটা চোখের খুব কাছে নিয়ে এলাম, আর রাস্তার ল্যাম্পের অল্প আলোতেই যা দেখবার সেটা দেখে নিলাম।
ফেলুদা হাত বাড়িয়েই সিগারেটটা ফেরত নিয়ে নিল।
কী দেখলি?
চারমিনার। আর যে লোকটা খাচ্ছিল, তার মুখে পান ছিল, তাই পানের দাগ লেগে আছে।
ভেরি গুড। চ’ ভেতরে চ’।
রাত্রে শোবার আগে ফেলুদা ধীরুকাকার কাছ থেকে আংটিটা চেয়ে নিয়ে সেটা আরেকবার ভাল করে দেখে নিল। ওর যে পাথর সম্বন্ধে এত জ্ঞান ছিল সেটা আমি জানতাম না। ল্যাম্পের আলোতে আংটিটা ধরে সেটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগল—
এই যে নীল পাথরগুলো দেখছিস, এগুলোকে বলে স্যাফায়ার, যার বাংলা নাম নীলকান্ত মণি। লালগুলো হচ্ছে চুনি অর্থাৎ রুবি, আর সবুজগুলো পান্না—এমারেল্ড। অন্যগুলি যতদূর মনে হচ্ছে পোখরাজ—যার ইংরেজি নাম টোপ্যাজ। তবে আসল দেখবার জিনিস হল মাঝখানের ওই হিরেটা। এমন হিরে হাতে ধরে দেখার সৌভাগ্য সকলের হয় না।
তারপর ফেলুদা আংটিটা বা হাতের কড়ে আঙুলের পাশের আঙুলে পরে বলল, আওরঙ্গজেবের আঙুল আর আমার আঙুলের সাইজ মিলে যাচ্ছে, দেখেছিস।
সত্যিই দেখি ফেলুদার আঙুলে আংটিটা ঠিক ফিট করে গেছে।
ল্যাম্পের আলোতে ঝলমলে পাথরগুলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ফেলুদা বলল, কত ইতিহাস জড়িয়ে আছে এ আংটির সঙ্গে কে জানে। তবে কী জানিস তোপ্সে—এর অতীতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। এটা আওরঙ্গজেবের ছিল কি আলতামসের ছিল কি আক্রম খাঁর ছিল, সেটা আনিম্পরট্যান্ট। আমাদের জানতে হবে এর ভবিষ্যৎটা কী, আর বর্তমানে কোনও বাবাজি সত্যি করেই এর পেছনে লেগেছেন কি না, আর যদি লেগে থাকেন তবে তিনি কে এবং তাঁর কেন এই দুঃসাহস।
তারপর ফেলুদা আংটি হাত থেকে খুলে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল, যা, ফেরত দিয়ে আয়। আর এসে জানালাগুলো খুলে দে।
০২. পরদিন দুপুরে
পরদিন দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে আমরা ইমামবড় দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। বাবা আর ধীরুকাকা মোটরে গেলেন। গাড়িতে যদিও জায়গা ছিল, তবু ফেলুদা আর আমি দুজনেই বললাম যে আমরা টাঙ্গায় যাব।
সে দারুণ মজা। কলকাতায় থেকে তো ঘোড়ার গাড়ি চড়াই হয় না। সত্যি বলতে কী, আমি কোনও দিনই কোনওরকম ঘোড়ার গাড়ি চড়িনি। ফেলুদা অবিশ্যি চড়েছে। ও বলল কলকাতার ঠিকা গাড়ির চেয়ে টাঙ্গায় নাকি অনেক বেশি ঝাঁকুনি হয়, আর সেট নাকি হজমের পক্ষে খুব ভাল।
তোর কাকার বাবুর্চি যা ফাস্ট ক্লাস রাঁধে, বুঝছি এখানে খাওয়ার ব্যাপারে হিসেব রাখাটা খুব মুশকিল হবে। কাজেই মাঝে মাঝে এই টাঙ্গা রাইডটার এমনিতেই দরকার হবে।
নতুন শহরের রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে আর টাঙ্গার ঝাঁকুনি খেতে খেতে যে জায়গাটায় পৌঁছলাম, গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল সেটার নাম কাইজার-বাগ। ফেলুদা বলল, জর্মান আর উর্দুতে কেমন মিলিয়েছে দেখছিস?
নবাবি আমলের যত প্রাসাদ-টাসাদ সব নাকি এই কাইজার-বাগের আশেপাশেই রয়েছে। গাড়োয়ান এদিকে ওদিকে আঙুল দেখিয়ে সব নাম বলে দিতে লাগল।
উয়ো দেখিয়ে বাদশা মন্জিল…উয়ো হ্যায় চাঁদিওয়ালি বরাদরি…উস্কো বোলতা লাখুফটক…
কিছুদূর গিয়ে দেখি রাস্তাটা গেছে একটা বিরাট গেটের মধ্যে দিয়ে। গাড়োয়ান বলল, রুমি দরওয়াজা।
রুমি দরওয়াজা পেরিয়েই মচ্ছি ভওয়ন আর মচ্ছি ভওয়নেই হল বড়া-ইমামবড়া। ইমামবড়ার সাইজ দেখে আমার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। এত বড় প্রাসাদ যে হতে পরে সেটা আমার ধারণাই ছিল না।
টাঙ্গা থেকেই ধীরুকাকার গাড়িটা দেখতে পেয়েছিলাম। গাড়োয়ানকে ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে আমরা বাবাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাবা আর ধীরুকাকা একজন লম্বা মাঝবয়সী লোকের সঙ্গে কথা বলছেন।
ফেলুদা হঠাৎ আমার কাঁধে হাত দিয়ে চাপা গলায় বলল, ব্লাক স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড।
সত্যিই তো! ধীরুকাকার গাড়ির পাশে একটা কালো স্ট্যান্ডার্ড গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মাডগার্ডে একটা টাট্কা ঘষটার দাগ দেখছিস?
টাট্কা কী করে জানলে?
চুনের গুড়ে সব ঝরে পড়েনি এখনও—লেগে রয়েছে। রং-করা পাঁচিল কিংবা গেটের গায়ে ঘষটে ছিল বোধ হয়। আজ সকালে যদি গাড়ি ধোওয়া না হয়ে থাকে, তা হলে ও দাগ কাল রাত্রে লেগে থাকতে পারে।
ধীরুকাকা আমাদের দেখে বললেন, এসো আলাপ করিয়ে দিই! ইনিই বনবিহারীবাবু—যাঁর চিড়িয়াখানা আছে।
আমি অবাক হয়ে নমস্কার করলাম। ইনিই সেই লোক! প্রায় ছ ফুট লম্বা, ফরসা রং, সরু গোঁফ, ছুচলো দাড়ি, চোখে সোনার চশমা। সব মিলিয়ে চেহারাটা বেশ চোখে পড়ার মতো।
আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে ভদ্রলোক বললেন, লক্ষ্মণের রাজধানী কেমন লাগছে খোকা? জানো তো, রামায়ণের যুগে লখ্নৌ ছিল লক্ষ্মণাবতী। ভদ্রলোকের গলার আওয়াজও দেখলাম বেশ মানানসই। ধীরুকাকা বললেন, বনবিহারীবাবু চৌক-বাজারে যাচ্ছিলেন, আমাদের গাড়ি দেখে চলে এলেন।
ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ। দুপুরবেলাটা আমি বাইরে কাজ সারতে বেরোই। সকালসন্ধে আমার জনোয়ারগুলোর পেছনে অনেকটা সময় চলে যায়।