বাবা বললেন, কবে মারা গেছেন ভদ্রলোক? শ্রীবাস্তব বললেন, লাস্ট জুলাই। তিনমাস হল। মে মাসে ফাস্ট হার্ট অ্যাটাক হল। তাতেই প্রায় চলে গিয়েছিলেন। সেই টাইমে আংটি দিয়েছিলেন আমায়। দেবার পরে ভাল হয়ে উঠলেন। তারপর জুলাই মাসে সেকেন্ড আটক হল। তখনও আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিন দিনে চলে গেলেন। …এই দেখুন—
শ্রীবাস্তব তাঁর কোটের পকেট থেকে একটা দেশলাই-এর বাক্সর চেয়ে একটু বড় নীল রঙের ভেলভেটের কৌটো বার করে ঢাকনাটা খুলতেই তার ভেতরটায় রোদ পড়ে রামধনুর সাতটা রঙের একটা চোেখ ঝলসানো ঝিলিক খেলে গেল।
তারপর শ্রীবাস্তব এদিক ওদিক দেখে সামনে ঝুঁকে পড়ে খুব সাবধানে ডানহাতের বুড়ো আঙুল আর তার পাশের আঙুল দিয়ে আলতো করে ধরে আংটিটা বার করলেন।
দেখলাম আংটিটার উপরে ঠিক মাঝখানে একটা প্রায় চার আনির সাইজের ঝলমলে পাথর-নিশ্চয়ই হিরে–আর তাকে ঘিরে লাল নীল সবুজ সব আরও অনেকগুলো ছোট ছোট পাথর।
এত অদ্ভুত সুন্দর আংটি আমি কোনওদিন দেখিনি।
ফেলুদার দিকে আড়চোখে চেয়ে দেখি সে একটা শুকনো ইউক্যালিপটাসের পাতা নিয়ে কানের মধ্যে ঢুকিয়ে সেটাকে পাকাচ্ছে, যদিও তার চোখটা রয়েছে আংটির দিকে।
বাবা বললেন, দেখে তো মনে হয় জিনিসটা পুরনো। এর কোনও ইতিহাস আছে নাকি?
শ্রীবাস্তব একটু হেসে আংটিটা বাক্সে পুরে বাক্সটা পকেটে রেখে চায়ের পেয়ালাটা আবার হাতে তুলে নিয়ে বললেন, তা একটু আছে। এর বয়স তিনশো বছরের বেশি। এ আংটি ছিল আওরঙ্গজেবের।
বাবা চোখ কপালে তুলে বললেন, বলেন কী! আমাদের আওরঙ্গজেব বাদশা? শাজাহানের ছেলে আওরঙ্গজেব?
শ্রীবাস্তব বললেন, হাঁ—তবে আওরঙ্গজেব তখনও বাদশা বনেননি। গদিতে শাজাহান। সমরকন্দ দখল করবেন বলে ফৌজ পাঠাচ্ছেন বার বার—আর বার বার ডিফিট হচ্ছে। একবার আওরঙ্গজেবের আন্ডারে ফৌজ গেল। আওরঙ্গজেব মার খেলেন খুব। হয়তো মরেই যেতেন। এক সেনাপতি সেভ করল। আওরঙ্গজেব নিজের হাত থেকে আংটি খুলিয়ে তাকে দিলেন।
বাবা! এ যে একেবারে গল্পের মতো।
হাঁ। আর পিয়ারিলাল ওই আংটি কিনলেন ওই সেনাপতির এক বংশধরের কাছ থেকে আগ্রাতে। দাম কত ছিল তা পিয়ারিলাল বলেননি। তবে—দ্যাট বিগ স্টোন ইজ ডায়ামন্ড, আমি যাচাই করিয়ে নিয়েছি। বুঝতেই পারছেন কতো দাম হোবে।
ধীরুকাকা বললেন, কমপক্ষে লাখ দুয়েক। আওরঙ্গজেব না হয়ে যদি জাহান্নন খাঁ হত, তা হলেও লাখ দেড়েক হত নিশ্চয়ই।
শ্ৰীবাস্তব বললেন, তাইতে বলছি—কালকের ঘটনার পর খুব আপসেট হয়েছি। আমি একেলা মানুষ, রোগী দেখতে হামেশাই বাইরে যাচ্ছি। আজ যদি পুলিশকে বলি, কাল আমি বাইরে গেলে রাস্তায় কেউ যদি ইটপাটকেল ছুঁড়িয়ে মারে? একবার ভেবেছিলাম কি কোনও ব্যাঙ্কে রেখিয়ে দিই। তারপর ভাবলাম—এত সুন্দর জিনিস বন্ধুবান্ধবকে দেখিয়েও আনন্দ। ওই জন্যেই তো রেখে দিলাম নিজের কাছে।
ধীরুকাকা বললেন, অনেককে দেখিয়েছেন ও আংটি?
মাত্র তিনমাস হল তো পেলাম। আর আমার বাড়িতে খুব বেশি কেউ তো আসে না। যাঁরা এলেন—বন্ধুলোক, ভদ্রলোক, তাঁদেরই দেখিয়েছি।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ইউক্যালিপটাসের মাথায় একটু রোদ লেগে আছে, তাও বেশিক্ষণ থাকবে না। শ্রীবাস্তবকে দেখছিলাম কিছুতেই স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিলেন না।
ধীরুকাকা বললেন, চলুন ভিতরে গিয়ে বসা যাক। ব্যাপার নিয়ে একটু ভাবা দরকার।
আমরা সবাই বাগান ছেড়ে গিয়ে বৈঠকখানায় বসলাম। ফেলুদাকে দেখে মনেই হচ্ছিল না যে ওর এই আংটির ব্যাপারটা একটুও ইন্টারেস্টিং লাগছে। ও সোফাতে বসেই পকেট থেকে তাসের প্যাকেট বার করে হাতসাফাই প্রাকটিস করতে লাগল।
বাবা এমনিতে বেশি কথা বলেন না, কিন্তু যখন বলেন তখন বেশ ভেবেচিন্তে ঠাণ্ডা মাথায়। বলেন। বাবা বললেন, আচ্ছা, আপনি কেন ভাবছেন যে আপনার ওই আংটিটা নিতেই ওরা এসেছিল? আপনার অন্য কোনও জিনিস চুরি যায়নি? এমনও তো হতে পারে যে ওরা সাধারণ চোর, টাকাকড়ি নিতেই এসেছিল?
শ্ৰীবাস্তব বললেন, ব্যাপার কী বলি। বনবিহারীবাবু আছেন বলে এমনিতেই আমাদের পাড়ায় চোর-টোর আসে না। আর আমার পাশের বাড়িতে থাকেন মিস্টার ঝুনঝুনওয়ালা, আর তার পাশের বাড়িতে থাকেন মিস্টার বিলিমোরিয়া-বোথ ভেরি রিচ। আর সেটা তাদের বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। তাদের কাছে আমি কী? তাদের বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়ি আসবে কেন চোর?
ধীরুকাকা বললেন, তারা যেমন ধনী, তেমনি তাদের পাহারার বন্দোবস্তও নিশ্চয়ই খুব জমকালো। সুতরাং চোর সে বাড়িতে যাবে কেন? তারা তো বিরাট ধনদৌলতের আশায় যাবে না। শ পাঁচেক টাকা মারতে পারলে তাদের ছ মাসের খোরাক হয়ে যায়। কাজেই আমার-আপনার বাড়িতে চোর আসার ব্যাপারে অবাক হবার কিছু নেই।
শ্রীবাস্তব তবু যেন ভরসা পাচ্ছিলেন না। উনি বললেন, আমি জানি না মিস্টার সানিয়াল—আমার কেন জানি মনে হচ্ছে চোর ওই আংটি নিতেই এসেছিল। আমার পাশের ঘরের একটা আলমারি খুলেছিল। দেরাজ খুলেছিল। তাতে অন্য জিনিস ছিল। নিতে পারত। টাইম ছিল। আমার ঘুম ভাঙতে চোর পালিয়ে গেলো, একেবারে কিছু না নিয়ে। আর, কথা কী জানেন?—
শ্ৰীবাস্তব হঠাৎ থামলেন। তারপর ভ্রূকুটি করে কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, পিয়ারলাল যখন আমাকে আংটি দিয়েছিলেন, তখন মনে হল কী—উনি আংটি নিজের বাড়িতে রাখতে চাইলেন না। তাই আমাকে দিয়ে দিলেন। আউর—