একটা গাড়ি যেন পিছন থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বার বার হর্ন দিচ্ছে। বনবিহারীবাবু বললেন, এ তো জ্বালাল দেখছি! পাশ দাও হে ড্রাইভার, পাশ দাও–নইলে প্যাক্ প্যাক করে কান ঝালাপালা করে দেবে।
ড্রাইভার বাধ্যভাবে গাড়িটাকে রাস্তার একটু বাঁদিকে নিল, আর আমনি একটা পুরনো ধরনের শোভ্রোলে ট্যাক্সি আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে এগিয়ে গেল! যাবার সময় দেখলাম যে সে-গাড়ির পিছনের সিটে বসা একজন লোক মুখ বার করে আমাদের দিকে দেখে নিল।
এ আমাদের চেনা লোক—সেই বেরিলি পর্যন্ত যাওয়া গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী।
১১. লছমনঝুলা যাব
আমরা আগেই ঠিক করেছিলাম যে প্রথমে লছমনঝুলা যাব, তারপর সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থেকে দুপুরের খাওয়া সেরে ফেরার পথে হৃষীকেশট দেখে আসব। সত্যি বলতে কী, হৃষীকেশটা সম্বন্ধে আমার খুব বেশি উৎসাহ ছিল না। সেও তো তীর্থস্থান-পাণ্ডা ধর্মশালা অলিগলি ঘাট মন্দির, এই সব—কেবল গঙ্গাটা একটু অন্যরকম।
বনবিহারীবাবু এখন ফেলুদার গানটা ধরেছেন—
যব ছোড় চলে লখ্নৌ নগরী
তব হাল আদ পর ক্যা গুজরী!…
গান থামিয়ে হঠাৎ বনবিহারীবাবু বললেন, এই গানের সুরে জ্যোতি ঠাকুরের একটা বাংলা গান আছে জানো?
ফেলুদা বলল, জানি—কত কাল রবে বল ভারত হে।
ঠিক বলেছ।
তারপর আমার দিকে ফিরে বনবিহারীবাবু বললেন, Steal মানে হরণ, Horn মানে শিং, Sing গান, Gun মানে কামান, Come on মানে আইস, I saw মানে আমি দেখিয়ছিলাম—এটা জানো?
এটা আমি জানতাম না; শুনে খুব মজা লাগল, আর মনে মনে মুখস্থ করে নিলাম।
বনবিহারীবাবু বললেন, এটার জন্যই বোধহয় আমার গান বলতেই বন্দুকের কথা মনে পড়ে, আর বন্দুক বলতেই জিম করবেট। শিকারি করবেটের কথা জান তো?
ফেলুদা বলল, জানি।
তিনি কিন্তু এই সব অঞ্চলে মানুষখেকো বাঘ মেরে গেছেন। আমার করবেটকে কেন এত ভাল লাগে জান? কারণ উনিও আমার মতো জানোয়ারদের স্বভাব বুঝতেন, ওদের ভালবাসতেন।
এই বলে আবার গুনগুন করে গান ধরলেন বনবিহারীবাবু।
গাড়ি ছুটে চলেছে লছমনঝুলার দিকে। বাঁদিকে পাহাড়, সামনে পাহাড়, ডানদিকে মাঝে মাঝে গঙ্গাটা দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ঘন জঙ্গল। আকাশে মেঘ জমছে। সূর্যটা এক একবার মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, আর তক্ষুনি বাতাসটা আরও ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আমি প্রথম দিকে কেবল লছমনঝুলার কথাই ভাবছিলাম, এখন আবার মাঝে মাঝে আংটির ব্যাপারটা মনটাকে খোঁচা দিতে আরম্ভ করেছে। অনেক কিছু নতুন জিনিস এ দুদিনে জানতে পেরেছি, কিন্তু আরও অনেক কিছুই যে এখনও জানতে বাকি আছে! মহাবীর কেন সন্দেহ করে যে পিয়ারিলাল স্বাভাবিক ভাবে মারা যাননি? পিয়ারিলাল কীসের জন্য চিৎকার করেছিলেন মারা যাবার আগে? পিয়ারিলাল কোন স্পাই-এর কথা বলতে চেয়েছিলেন? সে স্পাই কি আমাদের চেনার মধ্যে কেউ, না চেনার বাইরে?
এই সব ভাবতে ভাবতে আমার চোখটা গাড়ির সামনে আয়নাটার দিকে চলে গেল। আয়নায় ফেলুদাকে দেখা যাচ্ছে। সে অদ্ভুত তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে কী জানি দেখছে।
এবার আমি আড়চোখে ফেলুদার দিকে চেয়ে দেখি সে দেখছে তার সামনেই বসা ড্রাইভারের দিকে।
আমার চোখটাও প্রায় আপনা থেকেই ঘুরে ড্রাইভারের দিকে গেল, আর সেদিকে দৃষ্টি পড়তেই আমার বুকের ভিতরটা ছাৎ করে উঠল।
ড্রাইভারের পাগড়ির নীচে আর কোটের কলারের ঠিক উপরে ঘাড়ের মাঝখানে আঁচড়ের দাগ।
এ রকম দাগ আমরা আরেকজনের ঘাড়ে দেখেছি।
সে হল গণেশ গুহ।
আবার ফেলুদার দিকে চেয়ে দেখি সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে জানালার বাইরে দেখছে। তাকে এমন গম্ভীর এর আগে আমি কখনও দেখিনি।
কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টে বসে গণেশ গুহ বলেছিল সে বনবিহারীবাবুর চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেই দিনই কলকাতায় চলে যাচ্ছে। আর আজ সে পাঞ্জাবি ড্রাইভারের ছদ্মবেশে আমাদের নিয়ে চলেছে লছমনঝুলা! হঠাৎ মনে পড়ল বনবিহারীবাবুই এই ট্যাক্সি ঠিক করে দিয়েছেন। তা হলে কি…?.
আমি আর ভাবতে পারলাম না। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করতে আরম্ভ করেছে। আমরা কোথায় চলেছি এখন? লছমনঝুলা, না অন্য কোথাও? বনবিহারীবাবুর উদ্দেশ্যটা কী? অথচ তাঁকে দেখে তো তাঁর মনে কোনও রকম উত্তেজনা বা দুরভিসন্ধি আছে বলে মনে হয় না।
হঠাৎ বনবিহারীবাবুর গলার আওয়াজে চমকে উঠলাম।
আমরা বাঁয়ে একটা রাস্তা ধরব এবার। ওই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তাটা গেছে। কিছুদূর গেলেই একটা বাড়ি পাব, সেখানেই আমার অজগরটা থাকার কথা। যারার সময় একবার দেখে যাই, ফেরার পথে একেবারে বাক্সে পুরে নিয়ে গাড়িতে তুলে নেব। কী বলেন ফেলুবাবু?
আশ্চর্য শান্তভাবে ফেলুদা বলল, বেশ তো।
আমি কিন্তু একটা কথা না বলে পারছিলাম না—
আপনি যে বলেছিলেন অজগরটা লছমনঝুলায় আছে?
বনবিহারীবাবু হো হো করে হেসে উঠে বললেন, এটা যে লছমনঝুলা নয় সেটা তোমাকে কে বলল তপেশবাবু? হাওড়া বলতে কি কেবল হাওড়ার পুল আর তার আশপাশটা বোঝায়? লছমনঝুলা শুরু হয়ে গেছে এখান থেকেই। গঙ্গার ব্রিজ এখান থেকে মাইল দেড়েক।
শালবনের মধ্যে দিয়ে আগাছায় ঢাকা, প্রায় দেখা যায় না, এমন একটা পথ ধরে গাড়িটা বাঁ দিকে ঘুরল।লক্ষ করলাম ড্রাইভারটা এবার বনবিহারীবাবুর নির্দেশের অপেক্ষাও করল ন।–যেন তার আগে থেকেই জানা ছিল এ রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।