প্রথম দিনই সেটার একটা ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার বা হাতের কড়ে আঙুলের নখটা বড় সেটা জানিস তো? প্রথম দিনে হাটবার সময় ভুলভুলাইয়ার প্রত্যেকটি গলির মুখে দেওয়ালের গায়ে নখ দিয়ে ঘষে ১, ২, ৩ করে নম্বর দিয়ে রেখেছিলাম। সাত নম্বর গলির খুপরির মধ্যে ছিল আংটিটা। আমি জানতাম ওর চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর নেই। এদিকে হরিদ্বার যাব, অথচ আংটিটা লখ্নৌয়ে থেকে যাবে, এটা ভাল লাগছিল না, তাই সেদিন গিয়ে বার করে নিয়ে আসি।
আমার বুকের ভিতরটা আবার চিপ টিপ করতে আরম্ভ করেছে। বললাম–
কিন্তু সে ডাকাত যদি সন্দেহ করে যে তোমার কাছে আংটিটা আছে?
সন্দেহ করলেই বা। প্রমাণ তো নেই। আমার বিশ্বাস সন্দেহ করেনি, কারণ অত বুদ্ধি ওদের নেই।
কিন্তু তা হলে তোমার পিছনে এভাবে লেগেছিল কেন?
তার কারণ, আংটির লোভ ওরা ছাড়তে পারছে না। আর ওরা জানে যে আমি যদিন আছি, তদ্দিন ওদের সব প্ল্যান ভণ্ডুল করে দেবার ক্ষমতা আমার আছে।
কিন্তু— আমার গলা শুকিয়ে প্রায় আওয়াজই বেরোচ্ছিল না; কোনও রকমে ঢোক গিলে তবে কথাটা শেষ করতে পারলাম,—তার মানে তো তোমার সাংঘাতিক বিপদ হতে পারে।
বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়াই তো ফেলুমিত্তিরের ক্যারেক্টার।
কিন্তু–
আর কিন্তু না। এবার ঘুমো।
ফেলুদা একটা তুড়ি মেরে হাই তুলে পাশ বদল করল।
ধরমশালা এখন একেবারে চুপ। দূরে রাস্তায় একটা কুকুর ডেকে উঠল। পাশের ঘরে নাক ডাকার শব্দ একটানা চলেছে। ঘুম কি আসবে? ফেলুদার টেক্কামাক দেশলাইয়ের বাক্সে রোদের আলোতে ঝলমল করা বাদশাহী আংটির কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। এই আংটির ব্যাপারে কী অদ্ভুত সাহসের সঙ্গে ফেলুদা নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে তা ভাবতেও অবাক লাগে। অথচ এটাও ঠিক যে, ও যদি না থাকত, তা হলে হয়তো আংটি চুরিও হয়ে যেত, আর চোর ধরাও পড়ত না।
কির্র্র্র কিট্ কিট্ কিট্… কির্র্র্র কিট্ কিট্ কিট্…কির্র্র্র কিট্ কিট্ কিট্…
পাশের ঘর থেকে—কিন্তু মনে হয় যেন অনেক দূর থেকে—র্যাট্ল স্নেকের আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম বনবিহারীবাবু তাঁর প্রিয় সংগীত শুনছেন।
আর এই ঝুমঝুমির আওয়াজ শুনতে শুনতে বোধহয় ঘুমটা এসে গিয়েছিল।
বাবার ট্র্যাভলিং ক্লক-এ পাঁচটার সময় অ্যালাম দেওয়া ছিল, কিন্তু আমার ঘুম ভেঙে গেল সেটা বাজার একটু আগেই। তাড়াতাড়ি মুখটুখ ধুয়ে চা-টা খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য খাবারের কথা বলতে শ্রীবাস্তব বললেন, লছমনঝুলায় একেবারে ব্রিজের মুখেই দোকানে চমৎকার পুরি-তরকারি পাবেন। খাবার নেবার দরকার নেই।
সকলেই বেশ ভাল করে গরম জামা পরে নিয়েছিলাম। কারণ পথে তো ঠাণ্ডা হবেই, আর লছমনবুলার হাইট বেশি বলে সেখানে এমনিতেই এখানের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা।
পৌনে ছটার সময় দুটো ট্যাক্সি পর পর এসে ধরমশালার গেটের সামনে দাঁড়াল। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম বিলাসবাবুও এসেছেন। শুনলাম উনিও লছমনঝুলা যাবেন বলে আমাদের দলে ঢুকে পড়েছেন। কোন গাড়িতে উঠব ভাবছি, এমন সময় বনবিহারীবাবু এগিয়ে এসে বললেন, তিনজন তিনজন করে ভাগাভাগি হয়ে যেতে হবে অবশ্যই। জানোয়ার সম্বন্ধে আমার কিছু ইন্টারেস্টিং গল্প আছে, তপেশবাবু যদি চাও তো আমার গাড়িতে আসতে পারো।
আমি বললাম, শুধু আমি কেন, ফেলুদাও নিশ্চয় শুনতে চাইবে।
ফেলুদা কোনও আপত্তি করল না। তাই শেষ পর্যন্ত আমি, ফেলুদা আর বনবিহারীবাবু একটা গাড়িতে, আর বাবা, শ্রীবাস্তব আর বিলাসবাবু অন্য গাড়িটায় উঠলাম। শ্রীবাস্তবের সঙ্গে দেখলাম বিলাসবাবুর বেশ ভাব হয়ে গেছে।
সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বনবিহারীবাবু তাঁর কাঠের বাক্সটা রাখলেন। বললেন, এইটেতে আমার অজগর আসবে পিছনের সিটের মাঝখানে ফেলুদা, আর দুপাশে আমি আর বনবিহারীবাবু বসলাম।
ঠিক সোয়া ছটার সময় আমাদের গাড়ি দুটো একসঙ্গে রওনা দিল।
শহর ছাড়িয়ে খোলা জায়গায় পেঁৗছতে আরও পাঁচ মিনিট লাগল। সামনে পাহাড়। ডান দিকে চেয়ে থাকলে মাঝে মাঝে গঙ্গা দেখা যাচ্ছে। আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। বনবিহারীবাবুও বোধহয় বেশ ফুর্তিতেই আছেন, কারণ গুনগুন করে গান ধরেছেন। বোধহয় অজগরের আশাতেই ওঁর মনের এই ভাব।
ফেলুদাই কেবল দেখলাম একেবারে চুপ মেরে গেছে। কী ভাবছে ও? আংটিটা কি এখনও ওর পকেটেই আছে? সেটা জানার কোনও উপায় নেই। কারণ ও বনবিহারীবাবুর সামনে সিগারেট খাবে না।
বাবাদের ট্যাক্সিটা আমাদের সামনেই চলেছে। ট্যাক্সির পিছনের কাচের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিলাসবাবু শ্রীবাস্তবকে কী সব যেন বোঝাচ্ছেন। হয়তো শ্রীবাস্তব এই ফাঁকতালে তাঁর হাতটা দেখিয়ে নিচ্ছেন।
বনবিহারীবাবু হঠাৎ বললেন, শিশির-ভেজা রাস্তা থেকে এখনও ধুলো উঠছে না, কিন্তু রোদের তেজ বাড়লে উঠবে। আমার মনে হয় ওদের একটু এগিয়ে যেতে দেওয়া উচিত। এই ড্রাইভার—একটু আস্তে চালাও তো দিকি?
দাড়িওয়ালা পাগড়িপর পাঞ্জাবি ড্রাইভার বনবিহারীবাবুর কথা মতো গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিল, আর তার ফলে বাবাদের ট্যাক্সি বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল। ধুলো হোক আর যাই হোক, আমি মনে মনে চাইছিলাম গাড়ি দুটো যেন কাছাকাছি একসঙ্গে চলে, কিন্তু বনবিহারীবাবুর আদেশের উপর কিছু বলতে সাহস হল না। ভদ্রলোক জানোয়ারের গল্প আরম্ভ করবেন কখন?