হতে পারেন বিলাসবাবু হাত-দেখিয়ে, আমার কিন্তু তাঁর পা-টা দেখে ভারী অদ্ভুত লাগল। বুড়ো আঙুলটা তার পাশের আঙুলের চেয়ে প্রায় আধ ইঞ্চি বড়। আর সেটা দেখে মনে হল খুব রিসেন্টলি যেন আমি সেরকম পা দেখেছি। কিন্তু কোথায় বা কার পা সেটা মনে করতে পারলাম না।
বনবিহারীবাবু একটা হাফ-ছাড়ার শব্দ করে বললেন, যাক, বাঁচা গেল।
কেন মোশাই, আপনি কি শিকার করেন নাকি? বাঘ-ভালুক মারেন?
বিলাসবাবুর বাংলায় একটা অবাঙালি টান লক্ষ করলাম।
বনবিহারীবাবু বললেন, নাঃ। তবু—এ সব জেনে-টেনে রাখা ভাল। আমার এক খুড়তুতো ভাই—কোথাও কিছু নেই—হঠাৎ এক পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে হাইড্রোফোবিয়ায় মরল। তাই আর কী…
আপনি কি আগে কলকাতায় ছিলেন? বিলাসবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
বনবিহারীবাবু একটু অবাক হয়েই বললেন, ওটাও কি হাতের রেখায় পাওয়া যায় নাকি?
তাই তো দেখছি। আর.আপনার কি পুরনো আমলের শিল্পদ্রব্য বা অন্য দামি জিনিস জমানোর শখ আছে?
আমার? না না–আমার কেন? সে ছিল পিয়ারিলালের। আমার শখ জন্তু জানোয়ারের।
তাই কি? তাই কামড় খাওয়ার কথা বলছিলেন? কিন্তু…
কিন্তু কী?
বনবিহারীবাবুকে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হল। বিলাসবাবু প্রশ্ন করলেন, আপনার কি সম্প্রতি কোনও উদ্বেগের কারণ ঘটেছে?
সম্প্রতি মানে?-এই ধরুন—গত মাসখানেকের মধ্যে?
বনবিহারীবাবু বেশ জোরে হেসে উঠে বললেন, মিশাই—আমার, যাকে বলে, নট এ কেয়ার ইন দ্য ওয়লড। কোনও উদ্বেগ নেই। তবে হ্যাঁ—একটা অ্যাংজাইটি আছে এই যে, কাল লছমনঝুলায় গিয়ে একটা বারো ফুট অজগরের দেখা পাব কি না পাব।
বিলাসবাবুর বোধহয় আরেকটু দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বনবিহারীবাবু হঠাৎ হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে একটা হাই তুলে বললেন, আসলে ব্যাপারটা কী জানেন—কিছু মনে করবেন না—এ সব পামিষ্ট্রি-ফমিষ্ট্রিতে আমার বিশ্বাস নেই। আমাদের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সবই আমাদের হাতে বটে—কিন্তু সেটা হাতের রেখায় নয়। হাত বলতে আমি বুঝি ক্ষমতা, সামৰ্থ। সেইটের উপরেই সব নির্ভর করে।
এই বলে বনবিহারীবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে সোজা ঘরের ভিতর চলে গেলেন।
আমার চোখ আবার চলে গেল বিলাসবাবুর পায়ের দিকে।
অনেক ভেবেও কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কোথায় দেখেছি ওরকম লম্বা বুড়োআঙুলওয়ালা পা।
১০. ঝলমলে জিনিসটার কথা
সারাদিনের মধ্যে একবারও ফেলুদাকে সেই ঝলমলে জিনিসটার কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ। পেলাম না!
রাত্রে বাবা যদিও বললেন, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়, ভোরে উঠতে হবে— তবুও খাওয়া-দাওয়া করে বিছানা পেতে শুতে শুতে প্রায় দশটা হয়ে গেল।
লেপের তলায় যখন ঢুকছি, তখন আমাদের পাশাপাশি দুটো ঘরের মাঝখানের দরজা দিয়ে একটা বিকট নাক ডাকার আওয়াজ পেলাম।
ফেলুদা বলল, বিলাসবাবু।
কেন, কাল ট্রেনেও ডাকছিল—শুনিসনি?
ট্রেনে? বিলাসবাবু ট্রেনেও ছিলেন? তাই তো! একটা রহস্যের হঠাৎ সমাধান হয়ে গেল।
ওই বুড়ো আঙুল!
ফেলুদা আস্তে করে আমার পিঠ চাপড়ে বলল, গুড।
ঠিক কথা। আমাদের উপরের বাঙ্কে উনিই সারা রাস্তা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলেন। কেবল পায়ের ডগা দুটো বেরিয়ে ছিল বাঙ্ক থেকে, আর তখনই দেখেছিলাম ওই বুড়ো আঙুল।
কিন্তু এবার যে আসল প্রশ্নটা করতে হবে ফেলুদাকে। বাবার নড়াচড়া দেখে বুঝতে পারছিলাম উনি এখনও ঘুমোননি। বাবা না ঘুমোলে কথাটা বলা চলে না, তাই আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।
তাই এমনিতেই লোকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে; আমাদের ঘরের ভিতর অন্ধকার। বাইরে উঠোনে বোধহয় একটা লাইট জ্বলছে আর তারই আলো আমাদের দরজার চৌকাঠে এসে পড়েছে। একবার আমাদের ঘরের মেঝে থেকে যেন খুট করে একটা শব্দ এল। বোধহয় ইঁদুর-টিদুর কিছু হবে।
এবার বাবার খাটিয়া থেকে শুনলাম ওঁর জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ার শব্দ। বুঝলাম উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি ফেলুদার দিকে ফিরলাম। তারপর গলা নামিয়ে একেবারে ফিসফিস করে বললাম, ওটা আংটিই ছিল, তাই না?
ফেলুদা কিছুক্ষণ চুপ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমারই মতো ফিসফিস্ করে বলল, তুই যখন জেনেই ফেলেছিস, তখন আর তোর কাছে লুকোনোর কোনও মানে হয় না। আংটিটা আমার কাছেই রয়েছে, সেই প্রথম দিন থেকেই। তোরা সব ঘুমিয়ে পড়ার পর, ধীরুকাকার ঘরে আলনায় ঝোলানো ওঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে আংটিটা বার করে নিই। বাক্সটা নিইনি যাতে ডেফিনিটলি বোঝা যায় আংটিটা গেছে।
কিন্তু কেন নিলে আংটিটা?
কারণ ওটা সরিয়ে রাখলে আসল ডাকাতকে উসকে দিয়ে তাকে ধরার আরও সুবিধে হবে বলে।
তা হলে সেই সন্ন্যাসী কি আংটিটাই নিতে এসেছিলেন?
অম্বিকীবাবু নয়; আরেকজন সন্ন্যাসী, যে নকল। যার হাতে অ্যাটাচি কেস ছিল। সে-ই এসেছিল চুরি করতে, কিন্তু গেট থেকেই বৈঠকখানায় আরেকজন গেরুয়াধারীকে দেখে চম্পট দেয়। তারপর টাঙ্গা করে স্টেশনে গিয়ে ওয়েটিংরুমে ঢুকে পোশাক বদলে নেয়।
সেই নকল সন্ন্যাসী কে?
একটা সন্দেহ আছে মনে, কিন্তু এখনও প্রমাণ পাইনি।
এতদিন ধরে তুমি ওই আংটি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছ?
না।
তবে?
একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে দিয়েছিলাম।
কোথায়?
ভুলভুলাইয়ার একটা খুপরির ভিতর।
বাপরে বাপ্! কী সাংঘাতিক বুদ্ধি! এতদিনে বুঝতে পারলাম ফেলুদার দ্বিতীয়বার ভুলাভুলাইয়া যাবার এবং গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যাবার কারণটা। কিন্তু তবু মনে একটা খটকা লাগল, তাই জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু তুমি তো ভুলভুলাইয়ার প্ল্যান জানতে না।