তাই তো শুনিচি। একবার এক গোৱাপল্টন—অনেকদিন আগে—মদটদ খেয়ে বাজি ধরে নাকি ঢুকেছিল ওর ভেতরে। বলেছিল কেউ যেন ধাওয়া না করে—ও নিজেই বেরিয়ে আসবে। দুদিন পরে ওর মৃতদেহ পাওয়া যায় ওই গোলকধাঁধার এক গলিতে।
আমার বুকের ভেতরটা এর মধ্যেই টিপটিপ করতে শুরু করেছে।
ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি এক গিয়েছিলে, না গাইড নিয়ে?
গাইড নিয়ে। তবে একাও যাওয়া যায়।
সত্যি?
আমি তো অবাক। তবে ফেলুদার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।
কী করে এক যাওয়া যায় ফেলুদা?
ফেলুদা চোখটা ঢুলুঢুলু করে ঘাড়টা দুবার নাড়িয়ে চুপ করে গেল। বুঝলাম ও আর কথা বলবে না। এখন ও শহরের পথঘাট বাড়িঘর লোকজন এক্কা টাঙ্গা সব খুব মন দিয়ে লক্ষ করছে।
ধীরুকাক কুড়ি বছর আগে লখ্নৌতে প্রথম আসেন উকিল হয়ে। সেই থেকে এখানেই আছেন, এবং এখন নাকি ওঁর বেশ নামডাক। কাকিমা তিনবছর হল মারা গেছেন, আর ধীরুকাকার ছেলে জামানির ফ্র্যাংকফার্ট শহরে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। ওঁর বাড়িতে এখন উনি থাকেন, ওঁর বেয়ারা জগমোহন থাকে, আর রান্না করার বাবুর্চ আর একটা মালী। ওঁর বাড়িটা যেখানে সে জায়গাটার নাম সেকেন্দার বাগ, স্টেশন থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাইল দূরে। বাড়ির সামনে গেটের উপর লেখা—ভি. কে. সান্ন্যাল এম এ, বি.এল. বি., অ্যাডভোকেট। গেট দিয়ে ঢুকে খানিকট নুড়ি পাথর ঢালা রাস্তার পর একতলা বাড়ি, আর রাস্তার দুদিকে বাগান। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন মালী লন মোয়ার দিয়ে বাগানের ঘাস কাটছে।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বাবা বললেন, ট্রেন জার্নি করে এসেছ আজ আর বেরিয়ো না। কাল থেকে শহর দেখা শুরু করা যাবে। তাই সারা দুপুর বাড়িতে বসে ফেলুদার কাছে তাসের ম্যাজিক শিখেছি। ফেলুদা বলে—ইন্ডিয়ানদের আঙুল ইউরোপিয়ানদের চেয়ে অনেক বেশি ফ্লেক্সিবল। তাই হাত সাফাইয়ের খেলাগুলো আমাদের পক্ষে রপ্ত করা অনেক সহজ।
বিকেলে যখন ধীরুকাকার বাগানে ইউক্যালিপটাস্ গাছটার পাশে বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছি, তখন গেটের বাইরে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ পেলাম। ফেলুদা না দেখেই বলল ফিয়াট। তারপর রাস্তার পাথরের উপর দিয়ে খচমচ খচমচ করতে করতে ছাই রঙের সুট পর একজন ভদ্রলোক এলেন। চোখে চশমা, রং ফরসা আর মাথার চুলগুলো বেশির ভাগই সাদা। কিন্তু তাও দেখে বোঝা যায় যে বয়স বাবাদের চেয়ে খুব বেশি নয়।
ধীরুকাকা হেসে নমস্কার করে উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমে বললেন, জিগমোহন, আউর এক কুরসি লাও, তারপর বাবার দিকে ফিরে বললেন, আলাপ করিয়ে দিই—ইনি ডক্টর শ্রীবাস্তব, আমার বিশিষ্ট বন্ধু।
আমি আর ফেলুদা দুজনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ফেলুদা ফিসফিস করে বলল, নার্ভাস হয়ে আছে। তোর বাবাকে নমস্কার করতে ভুলে গেল।
ধীরুকাকা বললেন, শ্রীবাস্তব হচ্ছেন অস্টিওপ্যাথ, আর একেবারে খাস লখ্নৌইয়া।
ফেলুদা চাপা গলায় বলল, অস্টিওপ্যাথ মানে বুঝলি?
আমি বললাম, না।
হাড়ের ব্যারামের ডাক্তার। অস্টিও আর অস্থি—মিলটা লক্ষ করিস। অস্থি মানে হাড় সেটা জানিস তো?
তা জানি।
আরেকটা বেতের চেয়ার এসে পড়াতে আমরা সকলেই বসে পড়লাম। ডক্টর শ্রীবাস্তব হঠাৎ ভুল করে বাবার চায়ের পেয়ালাটা তুলে আরেকটু হলেই চুমুক দিয়ে ফেলতেন, এমন সময় বাবা একটু খুক খুক্ করে কাশাতে আই অ্যাম সে সরি বলে রেখে দিলেন।
ধীরুকাকা বললেন, আজ যেন তোমায় একটু ইয়ে বলে মনে হচ্ছে। কোনও কঠিন কেসটেস দেখে এলে নাকি?
বাবা বললেন, ধীরু, তুমি বাংলায় বলছ—উনি বাংলা বোঝেন বুঝি?
ধীরুকাক হেসে বললেন, ওরে বাবা, বোঝেন বলে বোঝেন! তোমার বাংলা আবৃত্তি একটু শুনিয়ে দাও না।
শ্রীবাস্তব যেন একটু অপ্রস্তুত হয়েই বললেন, আমি বাংলা মোটামুটি জানি। ট্যাগোরও পড়েছি কিছু কিছু।
বটে?
ইয়েস। গ্রেট পোয়েট।
আমি মনে মনে ভাবছি। এই বুঝি কবিতার আলোচনা শুরু হয়, এমন সময় কাঁপা হতে তারই জন্যে ঢালা চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিয়ে শ্রীবাস্তব বললেন, কাল রাতে আমার বাড়িতে ডাকু আসিয়াছিল।
ডাকু? ডাকু আবার কে? আমাদের ক্লাসে দক্ষিণা বলে একটা ছেলে আছে যার ডাকনাম ডাকু ৷
কিন্তু ধীরুকাকার কথাতেই ডাকু ব্যাপারটা বুঝে নিলাম।
সেকী—ডাকাত তো মধ্য প্রদেশেই আছে বলে জানতাম। লখ্নৌ শহরে আবার ডাকাত এল কেথেকে?
ডাকু বলুন, কি চোর বলুন। আমার অঙ্গুরীর কথা তো আপনি জানেন মিস্টার সানিয়াল?
সেই পিয়ারিলালের দেওয়া আংটি? সেটা কি চুরি গেল নাকি?
না, না। লেকিন আমার বিশ্বাস কি, ওই আংটি নিতেই চোর আসিল।
বাবা বললেন, কী আংটি?
শ্ৰীবাস্তব ধীরুকাকাকে বললেন, আপনি বোলেন। উর্দুভাষা এরা বুঝবেন না আর অত কথা আমার বাংলায় হোবে না :
ধীরুকাকা বললেন, পিয়ারিলাল শেঠ ছিলেন লখ্নৌ-এর নামকরা ধনী ব্যবসায়ী! জাতে গুজরাটি এককালে কলকাতায় ছিলেন। তাই বাংলাও অল্প অল্প জানতেন। ওর ছেলে মহাবীরের যখন বারো কি তেরো বছর বয়স, তখন তার একটা কঠিন হাড়ের ব্যারাম হয়। শ্ৰীবাস্তব তাকে ভাল করে দেন। পিয়ারিলালের স্ত্রী নেই, দুই ছেলের বড়টি টাইফয়েডে মারা যায়। তাই বুঝতেই পারছ, সবেধন নীলমণিটিকে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য শ্রীবাস্তবের উপর পিয়ারিলালের মনে একটা গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল। তাই মারা যাবার আগে তিনি তাঁর একটা বহুমূল্য আংটি শ্রীবাস্তবকে দিয়ে যান।