ধীরেন না? চিনতে পারছ?
ধীরুকাক কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো চেয়ে থেকে, হঠাৎ—অম্বিকা নাকি?—বলে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন। বাপরে বাপ!—তোমার আবার এ-পোশাক কী হে?
ধীরুকাক তখন ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, অম্বিকা হল আমার স্কুলের সহপাঠী। প্রায় পনেরো বছর পরে দেখা ওর সঙ্গে।
গার্ড হুইস্ল দিয়েছে। ঘ্যাঁ–চ করে গাড়ি ছাড়ার শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই শুনতে পেলাম অম্বিকাবাবু ধীরুকাকাকে বলছেন, আরে, সেদিন বিকেলে তোমার বাড়ি গিয়ে প্রায় আধঘণ্টা বসে রইলাম। তুমি ছিলে না। তোমার বেয়ারা তোমাকে সে কথা বলেনি?
ধীরুকাক কী উত্তর দিলেন সেটা আর শোনা গেল না, কারণ গাড়ি তখন ছেড়ে দিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে প্রথমে ফেলুদা, আর তারপর বাবার দিকে চাইলাম! ফেলুদার কপালে দারুণ ভ্রূকুটি।
বাবা বললেন, ভেরি স্ট্রেঞ্জ।
বনবিহারীবাবু বললেন, ওই ভদ্রলোককেই কি আপনার আংটিচোর বলে সাসপেক্ট করছিলেন?
বাবা বললেন, সে-প্রশ্ন অবিশ্যি আর ওঠে না। কিন্তু আংটিটা তা হলে গেল কোথায়? কে নিল?
ট্রেনটা ঘটং ঘটং করে লখ্নৌ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে বেরোল। স্টেশনের মাথার গম্বুজগুলো ভারী সুন্দর দেখতে, কিন্তু এখন আর ও সব যেন চোখেই পড়ছিল না। মাথার মধ্যে সব যেন কীরকম গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। ফেলুদা নিশ্চয়ই মনে মনে খুব অপ্রস্তুত বোধ করছে। ও-তো সেই সন্ন্যাসীর খোঁজ নিতে নিতে একেবারে লখ্নৌ স্টেশন অবধি পৌঁছে গিয়েছিল।
কিন্তু তা হলে স্টেশনের সেই অ্যাটাচি-কেসওয়ালা সন্ন্যাসী কে? আজকে যাকে দেখলাম সে তো আর ছদ্মবেশধারী সন্ন্যাসী নয়—একেবারে সত্যিকার সন্ন্যাসী। সে কি তা হলে আরেকজন লোক? আর সেও কি ধীরুকাকার বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। আর সেটার কারণ কি ওই আংটি, না অন্য কিছু? আর ফেলুদার গায়ে খুব হুঁশিয়ার লেখা কাগজ কে ছুড়ে মেরেছিল—আর কেন?
ফেলুদার মাথাতে কি এখন এই সব প্রশ্নই ঘুরছে—না সে অন্য কিছু ভাবছে?
ওর দিকে চেয়ে দেখি ও সেই গ্রিক অক্ষরে হিজিবিজি লেখা খাতাটা বার করে খুব মন দিয়ে পড়ছে—আর মাঝে মাঝে কলম দিয়ে আরও কী সব জানি লিখছে।
বনবিহারীবাবু হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসলেন : আচ্ছা, ডক্টর শ্রীবাস্তব—পিয়ারিলাল মারা যাবার আগে আপনিই বোধহয় শেষ তাঁকে দেখেছিলেন, তাই না?
শ্ৰীবাস্তব একটা থলি থেকে কমলালেবু বার করে সকলকে একটা একটা করে দিতে দিতে বললেন, আমি ছিলাম, ওনার বিধবা বোন ছিলেন, ওনার বেয়ারা ছিল, আর অন্য একটি চাকরও ছিল।
বনবিহারীবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, হুঁ।…ওঁর অ্যাটাকটা হবার পর আপনাকে খবর দিয়ে আনানো হয়?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি কি হার্টের চিকিৎসাও করেন?
হাড়ের চিকিৎসা করলে হার্টের যে করা যায় না এমন তো নয় বনবিহারীবাবু! আর ওঁর ডাক্তার গ্রেহ্যাম শহরে ছিলেন না, তাই আমাকে ডেকেছিলেন।
কে ডেকেছিল?
ওঁর বেয়ারা।
বেয়ারা? বনবিহারীবাবু ভু কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ। প্রীতম সিং। অনেক দিনের লোক! খুব বুদ্ধিমান, বিশ্বস্ত, কাজের লোক।
বনবিহারীবাবু মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে কমলালেবুর একটা কোয়া মুখে পুরে দিয়ে বললেন, আপনি বলেছেন পিয়ারিলাল আংটিটা দিয়েছেন প্রথম অ্যাটাকের পর। আর দ্বিতীয় অ্যাটাকের পর আপনাকে ডাকা হয়, আর সেই অ্যাটাকেই তাঁর মৃত্যু হয়।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আংটিটা দেবার সময় ঘরে কেউ ছিল কি?
তা কী করে থাকবে বনবিহারীবাবু? এ সব কাজ কি আর বাইরের লোকের সামনে কেউ করে? বিশেষ করে পিয়ারিলাল কী রকম লোক ছিলেন তা তো আপনি জানেন। ঢাক বাজিয়ে নোবল কাজ করার লোক তিনি একেবারেই ছিলেন না। ওনার কত সিক্রেট চ্যারিটি আছে তা জানেন? লাখ লাখ টাকা হাসপাতালে অনাথাশ্রমে দান করেছেন, অথচ কোনও কাগজে তার বিষয়ে কখনও কিছু বেরোয়নি।
হুঁ।
শ্ৰীবাস্তব বনবিহারীবাবুর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, আপনি কি আমার কথা অবিশ্বাস করছেন?
বনবিহারীবাবু বললেন, আসলে ব্যাপারটা কী জানেন—এই আংটি দেওয়ার ঘটনার অন্তত একজন সাক্ষী রাখলে আপনি বুদ্ধিমানের কাজ করতেন। এমন একটা মূল্যবান জিনিস হাত বদল হল—অথচ কেউ জানতে পারল না।
শ্রীবাস্তব একটুক্ষণ গম্ভীর থেকে হঠাৎ হো হো করে হেসে বললেন, বাঃ বনবিহারীবাবু, বাঃ! আমি পিয়ারিলালের আংটি চুরি করলাম, আমিই ধীরেনবাবুর কাছে সেটা রাখলাম, আবার আমিই সেটা ধীরেনবাবুর বাড়ি থেকে চুরি করলাম? ওয়ান্ডারফুল?
বনবিহারীবাবু তাঁর মুখের ভাব একটুও না বদলিয়ে বললেন, আপনি বুদ্ধিমানের কাজই করেছেন। আমি হলেও তাই করতাম। কারণ আপনার বাড়িতে ডাকাত পড়াতে আপনি সত্যিই ভয় পেয়েছিলেন, তাই আংটিটা ধীরুবাবুর কাছে রাখতে দিয়েছিলেন। তারপর ধীরুবাবু আলমারি থেকে সরিয়ে সেটা আবার নিজের কাছে রেখে ভাবছেন এইবার ডাকাতের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। কী বলো, ফেলু মাস্টার? আমার গোয়েন্দাগিরিটা কি নেহাত উড়িয়ে দেবার মতো?
ফেলুদা তার খাতা বন্ধ করে কমললেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ডাক্তার শ্রীবাস্তব যে মহাবীরকে প্রায় দুরারোগ্য ব্যারাম থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, তার কি কোনও সাক্ষীর অভাব আছে?
বনবিহারীবাবু বললেন, না তা হয়তো নেই।