ফেলুদা এবার মহাবীরের দিকে ফিরে বললেন, আপনি দেখেছেন বনবিহারীবাবুর চিড়িয়াখানা?
ইচ্ছে ছিল যাওয়ার—কিন্তু হয়নি। বাবার আপত্তি ছিল। ওই ধরনের জানোয়ার-টানোয়ার উনি একদম পছন্দ করতেন না। একটা আরশোলা দেখলেই বাবার প্রায় হা প্যালপিটেশন হয়ে যেত! তবে এবার ভাবছি একদিন গিয়ে দেখে আসব।
মহাবীর তুড়ি মেরে বেয়ারাকে ডাকল! ফেলুদা অবিশ্যি চায়ের দামটা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু মহাবীর দিতে দিল না। আমি মনে মনে ভাবলাম যে ফিল্মের অ্যাক্টরের অনেক টাকা, কাজেই মহাবীর দিলে কোনও ক্ষতি নেই।
বিলটা দেবার পর মহাবীর তার সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ফেলুদার দিয়ে এগিয়ে দিল। দেখলাম প্যাকেটটা চারমিনারের।
আপনি কদিন আছেন? মহাবীর জিজ্ঞেস করল।
পরশু দিন-দুয়েকের জন্য হরিদ্বার যাচ্ছি, তারপর ফিরে এসে বাকি এ মাসটা আছি।
আপনারা সবাই যাচ্ছেন হরিদ্বার?
ধীরেনবাবুর কাজ আছে তাই উনি যাবেন না। আমরা তিনজন যাচ্ছি, আর বোধ হয় বনবিহারীবাবু। উনি লছমনঝুলায় একটা অজগরের সন্ধানে যাচ্ছেন।
রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে পড়লাম। মহাবীর বলল, আমার কিন্তু গাড়ি আছে—আমি লিফট দিতে পারি।
ফেলুদা ধন্যবাদ দিয়ে বলল, না, থাক। মোটর তো কলকাতায় হামেশাই চড়ি। এখানে টাঙ্গাটা বেড়ে লাগছে।
এবার মহাবীর ফেলুদার কাছে এসে ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ করে সত্যিই ভাল লাগল। একটা কথা আপনাকে বলছি—যদি জানতে পারি যে বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবে হয়নি, তার জন্য অন্য কেউ দায়ী, তা হলে সেই অপরাধী খুনিকে খুঁজে বার করে তার প্রতিশোধ আমি নেবই। আমার বয়স বেশি না হতে পারে, কিন্তু আমি চার বছর মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ছিলাম। রিভলভারের লাইসেন্স আছে, আমার মতো অব্যৰ্থ টিপ খুব বেশি লোকের নেই। …গুড বাই।
মহাবীর রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে একটা কালো স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে উঠে হুশ করে বেরিয়ে চলে গেল।
ফেলুদা খালি বলল, সাবাস।
আমি মনে মনে বললাম, ফেলুদা যে বলেছিল প্যাঁচের মধ্যে প্যাঁচ সেটা খুব ভুল নয়।
টাঙ্গার খোঁজে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। এটাও বুঝতে পারছিলাম যে ব্লেড জিনিসটার খুব বেশি দরকার বোধহয় ফেলুদার নেই।
০৭. হরিদ্বার যেতে হয় ডুন এক্সপ্রেসে
হরিদ্বার যেতে হয় ডুন এক্সপ্রেসে। লখ্নৌ থেকে সন্ধ্যায় গাড়ি ছাড়ে, আর হরিদ্বার পৌঁছায় সাড়ে চারটায়।
লখ্নৌ আসার আগে যখন হরিদ্বার যাবার কথা হয় তখন আমার খুব মজা লেগেছিল। কারণ পুরী ছাড়া আমি কোনও তীর্থস্থান দেখিনি। কিন্তু লখ্নৌতে এসে আংটির ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় আর সে রহস্যের এখনও কোনও সমাধান না হওয়ায়, আমার এখন আর লখ্নৌ ছেড়ে যেতে খুব বেশি ইচ্ছা করছিল না।
কিন্তু ফেলুদার দেখলাম উৎসাহের কোনও অভাব নেই। ও বলল, হরিদ্বার, হৃষীকেশ আর লছমনঝুলা–এই তিনটে জায়গা পর পর দেখতে দেখবি কেমন ইন্টারেস্টিং লাগে। কারণ তিন জায়গার গঙ্গা দেখবি তিন রকম। যত উত্তরে যাবি তত দেখবি নদীর ফোর্স বেড়ে যাচ্ছে। আর ফাইন্যালি লছমনঝুলায় গিয়ে দেখবি একেবারে উত্তাল পাহাড়ে নদী। তোড়ের শব্দে প্রায় কথাই শোনা যায় না।
আমি বললাম, তোমার এ সব দেখা আছে বুঝি?
সেই যেবার ক্রিকেট খেলতে লখ্নৌ এলাম, সেবারই দেখা সেরে গেছি।
ধীরুকাক অবিশ্যি আমাদের সঙ্গে যেতে পারলেন না, তবে উনি নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের সকলকে স্টেশনে নিয়ে এলেন। কামরাতে মালপত্র রাখতে না রাখতে আরেকজন ভদ্রলোক এসে পড়লেন, তিনি হচ্ছেন ডাঃ শ্ৰীবাস্তব! আমি ভাবলাম উনিও বুঝি ধীরুকাকার মতো সি-অফ করতে এসেছেন, কিন্তু তারপর দেখলাম কুলির মাথা থেকে সুটকেস নামাচ্ছেন। আমাদের সকলেরই অবাক ভাব দেখে শ্ৰীবাস্তব হেসে বললেন, বীরুবাবুকে বলিয়েছিলাম যেন আপনাদের না বোলেম। উনি জানতেন আমি যাব আপনাদের সঙ্গে। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বোলেন তো!
বাবা দেখলাম খুশি হয়েই বললেন, খুব ভালই হল। আমি ভাবতে পারিনি আপনি আসতে পারবেন, তা না হলে আমি নিজেই আপনাকে বলতাম।
শ্রীবাস্তব বেঞ্চির একটা কোণ ঝেড়ে সেখানে বসে বললেন, সত্যি জানেন কী—কদিন বড্ড ওয়ারিড আছি। আমাকে বাইরে থেকে দেখলে বুঝতে পারবেন না। পিয়ারিলালের দেওয়া জিনিসটা এইভাবে গেল—ভাবলে বড় খারাপ লাগে। শহর ছেড়ে দুদিনের জন্য আপনাদের সঙ্গে ঘুরে আসতে পারলে খানিকটা শান্তি পাব।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে বনবিহারীবাবুও এসে পড়লেন। তাঁর মালপত্তর যেন একজনের পক্ষে একটু বেশিই মনে হল। ভদ্রলোক হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, এইবার রগড় দেখবেন। পবিত্ৰানন্দস্বামী চলেছেন এ-গাড়িতে। তাঁর ভক্তরা তাঁকে বিদায় দিতে আসছেন। ভক্তির বহরটা দেখবেন এবার।
সত্যিই, কিছুক্ষণ পরে অনেক লোকজন ফুলের মালাটালা নিয়ে একজন মোটামতো গেরুয়াপর লম্বা চুলওয়ালা সন্ন্যাসী এসে আমাদের পাশের ফার্স্টক্লাস গাড়িটায় উঠলেন।
ওঁর সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন গেরুয়াপরা লোক উঠল—আর কিছু গেরুয়াপরা, আর অনেক এমনি পোশাক পরা লোক কামরার সামনে ভিড় করে দাঁড়াল। বুঝলাম এরাই সব ভক্তের দল।
গাড়ি ছাড়তে আর পাঁচ মিনিট দেরি, তাই আমরা সব উঠে পড়েছি, ধীরুকাক কেবল জানালার বাইরে থেকে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন, এমন সময় একজন গেরুয়াপর লোক হঠাৎ ধীরুকাকার দিকে হাসিহাসি মুখ করে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল।