ওই তো মনিহারি দোকান ফেলুদা—ওখানে নিশ্চয়ই ব্লেড পাওয়া যাবে।
দাঁড়া, আগে একটা অন্য কাজ সেরে নিই।
আরও কিছুদূর গিয়ে ফেলুদা হঠাৎ একটা দোকান দেখে সেটার দিকে এগিয়ে গেল। দোকানের সামনে লাল সাইনবোর্ডে সোনালি উচু উচু অক্ষরে লেখা আছে—
MALKANH & CO
ANTIQUE & CURIO DEALERS
কাচের মধ্যে দিয়ে দোকানের ভিতরটা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম সেটা সব পুরনো আমলের জিনিসের দোকান। ঢুকে দেখি হরেক রকমের পুরনো জিনিসে দোকানটা গিজগিজ করছে—গয়নাগাটি কার্পেট ঘড়ি চেয়ার টেবিল ঝাড়লন্ঠন বাঁধানো ছবি আর আরও কত কী।
পাকচুলওয়ালা সোনার চশমা পরা একজন বুড়ো ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
ফেলুদা বলল, বাদশাদের আমলের গয়নাগাটি কিছু আছে আপনাদের এখানে?
গয়না তো নেই। তবে মুগল আমলের ঢাল তলোয়ার জাজিম বর্ম, এই সব কিছু আছে। দেখাব?
ফেলুদা একটা কাচের আতরদান হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, পিয়ারিলালের কাছে কিছু মুগল আমলের গয়না দেখেছিলাম। তিনি তো আপনার খুব বড় খদ্দের ছিলেন, তাই না?
ভদ্রলোক যেন অবাক হলেন।
বড় খদ্দের? কোন পিয়ারিলাল?
কেন—পিয়ারিলাল শেঠ, যিনি কিছুদিন আগে মারা গেলেন।
মালকানি মাথা নেড়ে বললেন, আমার কাছ থেকে কখনই কিছু কেনেননি তিনি, আর আমার চেয়ে বড় দোকান এখানে আর নেই।
আই সি। তা হলে বোধহয় যখন কলকাতায় ছিলেন তখন কিনেছিলেন।
তাই হবে।
এখানে বড় খদ্দের বলতে কাকে বলেন আপনি?
মালকানির মুখ দেখে বুঝলাম বড় খদ্দের তার খুব বেশি নেই। বললেন, বিদেশি টুরিস্ট এসে মাঝে মাঝে ভাল জিনিস ভাল দামে কিনে নিয়ে যায়। এখানের খদ্দের বলতে মিস্টার মেহতা আছেন, মাঝে মাঝে এটা সেটা নেন, আর মিস্টার পেস্টনজি আমার অনেক দিনের খদ্দের—সেদিন তিন হাজার টাকায় একটা কার্পেট কিনে নিয়ে গেছেন—খাস ইরানের জিনিস।
ফেলুদা হঠাৎ একটা হাতির দাঁতের তৈরি নৌকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওটা বাংলা দেশের জিনিস না?
হ্যাঁ, মুরশিদাবাদ।
দেখেছিস তোপ্সে—বজরাটা কেমন বানিয়েছে।
সত্যি, এত সুন্দর হাতির দাঁতের কাজ করা নৌকো আমি কখনও দেখিনি। বজরার ছাতে সামিয়ানার তলায় নবাব বসে গড়গড়া টানছে, তার দুপাশে পাত্রমিত্র সভাসদ সব বসে আছে, আর সামনে নাচগান হচ্ছে। ষোলোজন দাঁড়ি দাঁড় বাইছে, আর একটা লোক হাল ধরে বসে আছে। তা ছাড়া সেপাই বরকন্দাজ সব কিছুই আছে, আর সব কিছুই এত নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যে দেখলে তাক লেগে যায়।
ফেলুদা বলল, এটা কেথেকে পেলেন?
ওটা বেচলেন মিস্টার সরকার।
মিস্টার বি. সরকার—যিনি বাদশানগরে থাকেন। উনি মাঝে মাঝে এটা সেটা কিনে নিয়ে যান। ভাল জিনিস আছে ওঁর কাছে।
আই সি। ঠিক আছে। থ্যাঙ্ক ইউ। আপনার দোকান ভারী ভাল লাগল। গুড ডে।
গুড ডে, স্যার।
বাইরে এসে ফেলুদা বলল, বনবিহারী সরকারের তা হলে এ সব দোকানে যাতায়াত আছে। অবিশ্যি সে সন্দেহটা আমার আগেই হয়েছিল।
কিন্তু উনি যে বলেছিলেন এ সব ব্যাপারে ওঁর কোনও ইন্টারেস্ট নেই।
ইন্টারেস্ট না থাকলে পাথর দেখেই কেউ বলতে পারে সেটা আসল কি নকল?
মালকানি ব্রাদাসের সামনে দেখি এম্পায়ার বুক স্টল বলে একটা বইয়ের দোকান। ফেলুদা বলল ওর হরিদ্বার লছমনঝুল সম্বন্ধে একটা বই কেনা দরকার, তাই আমরা দোকানটায় ঢুকলাম, আর ঢুকেই দেখি পিয়ারিলালের ছেলে মহাবীর।
ফেলুদা ফিস্ফিস করে বলল, ক্রিকেটের বই কিনছে। ভেরি গুড।
মহাবীর আমাদের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে বই কিনছিল তাই আমাদের দেখতে পায়নি।
ফেলুদা দোকানদারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, নেভিল কাড়াসের কোনও বই আছে আপনাদের?
বলতেই মহাবীর ফেলুদার দিকে ফিরে তাকাল। আমি জানতাম নেভিল কার্ডাস ক্রিকেট সম্বন্ধে খুব ভাল ভাল বই লিখেছে।
দোকানদার বলল, কোন বইটা খুঁজছেন বলুন তো?
Centuries বইটা আছে?
আজ্ঞে না—তবে অন্য বই দেখাতে পারি।
মহাবীর মুখে হাসি নিয়ে ফেলুদার দিকে এগিয়ে এসে বলল, আপনার বুঝি ক্রিকেটে ইন্টারেস্ট?
হ্যাঁ। আপনারও দেখছি…
মহাবীর তার হাতের বইটা ফেলুদাকে দেখিয়ে বলল, এটা আমার অর্ডার দেওয়া ছিল। ব্র্যাডম্যানের আত্মজীবনী।
ওহো—ওটা পড়েছি। দারুণ বই।
আপনার কী মনে হয়—রণজি বড় ছিলেন, না ব্র্যাডম্যান?
দুজনে ক্রিকেটের গল্পে দারুণ মেতে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলার পর মহাবীর বলল, কাছেই কোয়ালিটি আছে, আসুন না একটু বসে চা খাই।
ফেলুদা আপত্তি করল না। আমরা তিনজনে গিয়ে কোয়ালিটিতে ঢুকলাম। ওরা দুজনে চা আর আমি কোকা-কোলা অর্ডার দিলাম। মহাবীর বলল, আপনি নিজে ক্রিকেট খেলেন?
ফেলুদা বলল, খেলতাম। স্লো স্পিন বল দিতাম। লখ্নৌয়ে ক্রিকেট খেলে গেছি। …আর আপনি!
আমি ডুন স্কুলে ফাস্ট ইলেভেনে খেলেছি। বাবাও স্কুলে থাকতে ভাল খেলতেন।
পিয়ারিলালের কথা বলেই মহাবীর কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেল।
ফেলুদা চা ঢালতে ঢালতে বলল, আপনি আংটির ঘটনাটা জানেন নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ। ডক্টর শ্রীবাস্তবের বাড়ি গিয়েছিলাম। উনি বললেন।
আপনার বাবার যে আংটি ছিল, আর উনি যে সেটা শ্রীবাস্তবকে দিয়েছিলেন সেটা আপনি জানতেন তো?
বাবা আমাকে অনেকদিন আগেই বলেছিলেন যে আমাকে ভাল করে দেবার জন্য শ্রীবাস্তবকে উনি একটা কিছু দিতে চান। সেটা যে কী, সেটা অবিশ্যি আমি বাবা মারা যাবার পর শ্রীবাস্তবের কাছেই জেনেছি।