এখানে কী বোঝা যাচ্ছে?
তুই নিজে বুঝতে পারছিস না?
আমি বুঝতে পারছি যে ওয়েটিংকুমের দারোয়ানটা অন্যমনস্ক ছিল।
তোর মুণ্ডু?
তবে?
সন্ন্যাসী বেরোলে নিশ্চয়ই দারোয়ানের চোখে পড়ত।
তা হলে? সন্ন্যাসী বেরোয়নি?
সন্ন্যাসীর হাতে কী ছিল মনে আছে?
আমি তো আর.ও হ্যাঁ হ্যাঁ–অ্যাটাচি কেস।
সন্ন্যাসীর হাতে অ্যাটাচি কেস দেখেছিস কখনও?
তা দেখিনি।
সেই তো বলছি। ওটা থেকেই সন্দেহ হয়।
কী সন্দেহ হয়?
যে সন্ন্যাসী আসলে সন্ন্যাসী নন। উনি প্যান্ট শার্ট কি ধুতি-পাঞ্জাবি পর আমাদের মতো অ-সন্ন্যাসী, আর সেই পোশাক ছিল ওই অ্যাটাচি কেসে। গেরুয়াটা ছিল ছদ্মবেশ। খুব সম্ভবত দাড়িগোঁফটও।
বুঝেছি। সেগুলো ও বাক্সে পুরে নিয়েছে, আর অন্য পোশাক পরে বেরিয়ে এসেছে। তাই দারোয়ান ওকে চিনতে পারেনি।
গুড়। এইবার মাথা খুলেছে।
কিন্তু আজ সকালে তা হলে কে তোমার গায়ে কাগজ ছুড়ে মারল?
হয় ও নিজেই, না হয় ওর কোনও লোক। স্টেশনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। আমি যে একে-তাকে সন্ন্যাসীর কথা জিজ্ঞেস করছি, সেটা ও শুনেছিল—আর তাই হুমকি দিয়ে গেল।
বুঝেছি। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও রহস্য আছে কি?
বাবা, বলিস কী; রহস্যের কোনও শেষ আছে নাকি? শ্ৰীবাস্তবকে স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে কে ফলো করল? সেও কি ওই সন্ন্যাসী, না অন্য কেউ? গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে চারমিনার আর পান খেতে খেতে কে ওয়াচ করছিল? পিয়ারিলাল কোন স্পাই-এর কথা বলতে চেয়েছিলেন? বনবিহারীবাবু হিংস্ৰ জানোয়ার পোষেন কেন? পিয়ারিলালের ছেলে বনবিহারীবাবুকে আগে কোথায় দেখেছে? সে আংটির ব্যাপার কতখানি জানে?…
***
রাত্রে বিছানায় শুয়ে এই সব রহস্যের কথাই ভাবছিলাম। ফেলুদা একটা নীল খাতায় কী যেন সব লিখল। তারপরে সাড়ে দশটায় শুয়ে পড়ল, আর শোবার কিছুক্ষণ পরেই জোরে জোরে নিশ্বাস। বুঝলাম ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
দূর থেকে রামলীলার ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। একবার একটা জানোয়ারের ডাক শুনলাম—হয়তো শেয়াল কিংবা কুকুর, কিন্তু হঠাৎ কেন জানি হাইনার হাসি বলে মনে হয়েছিল।
বনবিহারীবাবু যে হিংস্ৰ জানোয়ার পোষেন, তাতে ফেলুদার আশ্চর্য হবার কী আছে? সব সময় কি সব জিনিসের পিছনে লুকোনো কারণ থাকে অনেক রকম অদ্ভুত অদ্ভুত শখের কথা তো শুনতে পাওয়া যায়। বনবিহারীবাবুর চিড়িয়াখানাও হয়তো সেই রকমই একটা অদ্ভুত শখের নমুনা।
এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, আর কখন যে আবার ঘুমটা ভেঙে গেছে তা জানি না। জাগতেই মনে হল চারিদিক ভীষণ নিস্তব্ধ। ঢাকের বাজনা থেমে গেছে, কুকুর শেয়াল কিছু ডাকছে না। খালি ফেলুদার জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলার শব্দ, আর মাথার পিছনে টেবিলের উপর রাখা টাইম পিসটার টিক টিক শব্দ। আমার চোখটা পায়ের দিকের জানালায় চলে গেল।
জানালা দিয়ে রোজ রাত্রে দেখেছি আকাশ আর আকাশের তারা দেখা যায়। আজ দেখি আকাশের অনেকখানি ঢাকা। একটা অন্ধকার মতে কী যেন জানালার প্রায় সমস্তটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘুমের ঘোরটা পুরো কেটে যেতেই বুঝতে পারলাম সেটা একটা মানুষ। জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আমাদেরই ঘরের ভিতর দেখছে।
যদিও ভয় করছিল সাংঘাতিক, তবু লোকটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না। আকাশে তারা অল্প অল্প থাকলেও ঘরের ভিতর আলো নেই, তাই লোকটার মুখ দেখা অসম্ভব। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম যে তার মুখের নীচের দিকটা—মানে নাক থেকে থুতনি অবধি—একটা কালে কাপড়ে ঢাকা।
এবার দেখলাম লোকটা ঘরের ভিতর হাত ঢুকিয়েছে, তবে শুধু হাত নয়, হাতে একটা লম্বা ডান্ডার মতো জিনিস রয়েছে।
একটা মিষ্টি অথচ কড়া গন্ধ এইবার আমার নাকে এল। একে ভয়েতেই প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল, এখন হাত-পাও কী রকম যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল।
আমার মনে যত জোর আছে, সবটা এক সঙ্গে করে, শরীরটা প্রায় একদম না নাড়িয়ে, আমার বা হাতটা আমার পাশেই ঘুমন্ত ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলাম।
আমার চোখ কিন্তু জানালার দিকে। লোকটা এখনও হাতটা বাড়িয়ে রয়েছে, গন্ধটা বেড়ে চলেছে, আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।
আমার হাতটা ফেলুদার কোমরে ঠেকল। আমি একটা ঠেলা দিলাম। ফেলুদা একটু নড়ে উঠল। নড়তেই ক্যাঁচ করে খাটের একটা শব্দ হল। আর সেই শব্দটা হতেই জানালার লোকটা হাওয়া!
ফেলুদা ঘুমো ঘুমে গলায় বলল, খোঁচা মারছিস কেন?
আমি শুকনো গলায় কোনওরকমে ঢোক গিলে বললাম, জানালায়।
কে জানালায়? ঈস্—গন্ধ কীসের?—বলেই ফেলুদা একলাফে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর কিছুক্ষণ একদৃষ্টে বাইরের দিকে চেয়ে থেকে ফিরে এসে বলল, কী দেখলি ঠিক করে বল তো!
আমি তখনও প্রায় কাঠের মতো পড়ে আছি। কোনওমতে বললাম, একটা লোক…হাতে ভান্ডা…ঘরের ভেতর—
হাত বাড়িয়েছিল?
হ্যাঁ।
বুঝেছি। লাঠির ডগায় ক্লোরোফর্ম ছিল। আমাদের অজ্ঞান করবার তালে ছিল।
কেন?
বোধহয় আরেক আংটি-চোর। ভাবছে এখনও আংটি এখানেই আছে। যাকগে—তুই এ ব্যাপারটা আর বাবা কাককে বলিস না। মিথ্যে নার্ভাস-টার্ভাস হয়ে আমার কাজটাই ভেস্তে দেবে।
পরদিন সকালে বাবা আর ধীরুকাক দুজনেই বললেন যে আর বিশেষ কোনও গোলমাল হবে বলে মনে হচ্ছে না। আংটি উদ্ধারের ভার পুলিশের উপর দিয়ে দেওয়া হয়েছে, ইন্স্পেক্টর গরগরি কাজ শুরু করে দিয়েছেন।