ফেলুদা এতক্ষণ একটা সোফায় বসে একটা লাইফ ম্যাগাজিন দেখছিল, এবার সেটাকে বন্ধ করে টেবিলে রেখে দিয়ে হাত দুটোকে সোফার মাথার পিছনে এলিয়ে দিয়ে বলল, মহাবীরবাবু জানেন এ আংটির কথা?
পিয়ারিলালের ছেলে?
হ্যাঁ।
সে তো আমি জানি না ঠিক। মহাবীর ডুন স্কুলে পড়ত, ওখানেই থাকত। তারপর মিলিটারি একাডেমিতে জয়েন করেছিল। তারপর সেটা ছেড়ে দিল, বোম্বাই গিয়ে ফিল্মে অ্যাকটিং শুরু করল।
উনি ফিল্মে নামার ব্যাপারে পিয়ারিলালের মত ছিল?
সে বিষয়ে আমায় কিছু বলেননি পিয়ারিলাল। তবে জানি উনি ছেলেকে খুব ভালবাসতেন।
পিয়ারিলাল মারা যাবার সময় মহাবীর কাছে ছিলেন?
না। বোম্বাই ছিল। খবর পেয়ে এসে গেলো।
ধীরুকাকা বললেন, ফেলুবাবু যে একেবারে পুলিশের মতো জেরা করছ।
বাবা বললেন, ও যে শখের ডিটেকটিভ। ওর ওদিকে বেশ ইয়ে আছে।
শুনে শ্রীবাস্তব খুব অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাঃ—ভেরি গুড, ভেরি গুড?
কেবল ধীরুকাকাই যেন একটু ঠাট্টার সুরে বললেন, খোদ ডিটেক্টিভের বাড়ি থেকেই মালটা চুরি হল, এইটেই যা আপশোস।
ফেলুদা এ সব কথাবাতায় কোনও মন্তব্য না করে শ্রীবাস্তবকে আরেকটা প্রশ্ন করল, মহাবীরবাবুর ফিল্মে অ্যাকটিং করে ভাল রোজগার হচ্ছে কি?
শ্ৰীবাস্তব বললেন, সেটা ঠিক জানি না। মাত্র দুবছর তো হল?
ওঁর এমনিতে টাকার কোনও অভাব আছে?
নাঃ। কারণ, পিয়ারিলাল ওকেই সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। সিনেমাটা ওর শখের ব্যাপার।
হু!—বলে ফেলুদা আবার লাইফটা তুলে নিল।
শ্রীবাস্তব হঠাৎ তাঁর রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই দেখুন, আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার পেশেন্টের কথাই ভুলে গেছি। আমি চলি।
শ্রীবাস্তবকে তাঁর গাড়িতে পৌঁছে দিতে বাবা আর ধীরুকাকা বাইরে গেলে পর ফেলুদা ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে একটা বিরাট হাই তুলে বলল, তোর চাঁদে যেতে ইচ্ছে করে, না মঙ্গল গ্রহে?
আমি বললাম, আমার এখন শুধু একটা জিনিসই ইচ্ছে করছে।
ফেলুদা আমার কথায় কান না দিয়ে বলল, লাইফে চাঁদের সারফেসের ছবি দিয়েছে। দেখে জায়গাটাকে খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে না। মঙ্গল সম্বন্ধে তবু একটা কৌতুহল হয়।
আমি এবার একেবারে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললাম, ফেলুদা আমার কৌতুহল হচ্ছে তোমার ম্যানিব্যাগে যে কাগজটা আছে সেইটি দেখার জন্যে।
ওঃ—ওইটে!
ওটা দেখাবে না বুঝি?
ওটা উর্দুতে লেখা।
তবু দেখি না?
এই দ্যাখ।
ফেলুদা ভাঁজ করা কাগজটা বার করে সেটা দু আঙুলের ফাঁকে ধরে ক্যারামের গুটির মতো করে আমার দিকে ছুড়ে দিল। খুলে দেখি সেটায় লেখা আছে—খুব হুঁশিয়ার?
আমি বললাম, তবে যে বললে উর্দু?
বোকচন্দর—খুব আর হুঁশিয়ার—এই দুটো কথাই যে উর্দু সেটাও বুঝি তোর জানা নেই?
সত্যিই তো! মনে পড়ল একবার বাবা বলেছিলেন—যে-কোনও বাংলা উপন্যাস নিয়ে তার যে-কোনও একটা পাতা খুলে পড়ে দেখো, দেখবে প্রায় অর্ধেক কথা হয় উর্দু, নয় ফারসি, না হয় ইংরাজি—, না হয় পর্তুগিজ, না হয় অন্য কিছু। এ সব কথা বাংলায় এমন চলে গেছে যে, আমরা ভুলে গেছি এগুলো আসলে বাংলা নয়।
আমি লাল অক্ষরে লেখা কথা দুটোর দিকে চেয়ে আছি দেখে প্রায় যেন আমার মনের প্রশ্নটা আন্দাজ করেই ফেলুদা বলল, একটা সাজা পানের ডগা দিয়ে অনেক সময় চুন খয়ের মেশানো লাল রস চুইয়ে পড়ে দেখেছিস? এটা সেই পানের ডগা দিয়ে লাল রস দিয়ে লেখা।
আমি লেখাটা নাকের কাছে আনতেই পানের গন্ধ পেলাম।
কিন্তু কে লিখেছে বলো তো?
জানি না।
লোকটা বাঙালি তো বটেই?
জানি না।
কিন্তু তোমাকে কেন লিখতে যাবে? তুমি তো আর আংটি চুরি করেনি।
ফেলুদা হো হো করে হেসে বলল, হুমকি জিনিসটা কি আর চোরকে দেয় রে বোকা? ওটা দেয় চোরের যে শত্রু তাকে অর্থাৎ ডিটেকটিভকে। তাই এ সব কাজে নামতে হলে ডিটেক্টিভের একেবারে প্রাণটি হাতে নিয়ে নামতে হয়।
আমার বুকের ভিতরটা টিপ ঢিপ করে উঠল, আর বুঝতে পারলাম যে গলাটা কেমন জানি শুকিয়ে আসছে। কোনও রকমে ঢোক গিলে বললাম, তা হলে এবার থেকে সত্যিই হুঁশিয়ার হওয়া উচিত।
হুঁশিয়ার হইনি সে কথা তোকে কে বললে?—এই বলে ফেলুদা পকেট থেকে একটা গোল কৌটো বার করে আমার নাকের সামনে ধরল। দেখলাম বাক্সটার ঢাকনায় লেখা রয়েছে—দশংসংস্কারচুর্ণ।
ওটা যে একটা দাঁতের মাজনের নাম সেটা আমি ছেলেবেলা থেকে জানি—কারণ দাদু ওটা ব্যবহার করতেন। তাই আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, দাঁতের মাজন দিয়ে কী করে হুঁশিয়ার হবে ফেলুদা।
তোর যেমন বুদ্ধি!—দাঁতের মাজন হতে যাবে কেন?
তবে ওটায় কী আছে?
চোখ দুটো গোল করে গলাটা বাড়িয়ে আর নামিয়ে নিয়ে ফেলুদা বলল, চুর্ণীকৃত ব্ৰহ্মাস্ত্র।
০৫. রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ফেলুদা হঠাৎ বলল, তোপ্সে, কী মনে হচ্ছে বল তো?
আমি বললাম, কীসের কী মনে হচ্ছে?
এই যে-সব ঘটনা ঘটছে-টটছে।
বারে বা, সে তো তুমি বলবে। আমি আবার কী করে বলব? আমি কি ডিটেকটিভ নাকি? আর সন্ন্যাসীটা কে, সেটা না জানা অবধি তো কিছুই বোঝা যাবে না।
কিন্তু কিছু কিছু জিনিস তো বোঝা যাচ্ছে। যেমন, সন্ন্যাসীটা বাথরুমে ঢুকে আর বেরোল না। এটা তো খুব রিভিলিং।
রিভিলিং মানে?
রিভিলিং মানে যার থেকে অনেক কিছু বোঝা যায়।