গাড়োয়ান একটুক্ষণ ভেবে বলল, মনে হয় একটা বাক্স ছিল। তবে, বড় নয়, ছোট।
হুঁ।
স্টেশনে পৌঁছে টিকিট ঘরের লোক, গেটের চেকার, কুলি-টুলি এদের কাউকে জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হল না। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বাঙালি; তিনি বললেন, আপনি কি পবিত্ৰানন্দ ঠাকুরের কথা বলছেন? যিনি দেরাদুনে থাকেন? তিনি তো তিনদিন হল সবে এসেছেন। তাঁর তো এখনও ফিরে যাবার সময় হয়নি। আর তাঁর সঙ্গে তো দেদার সাঙ্গোপাঙ্গ চেলাচামুণ্ডা?
সবশেষে ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুমের যে দারোয়ান, তাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল একজন গেরুয়াপরা দাড়িওয়ালা, লোক গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল বটে।
ওয়েটিংরুমে বসেছিলেন?
আজ্ঞে না। বসেননি।
তবে?
বাথরুমে ঢুকেছিলেন। হাতে একটা ছোট বাক্স ছিল।
তারপর?
তারপর তো জানি না।
সে কী? বাথরুমে ঢোকার পর তাকে আর দেখোনি?
দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।
তুমি এখানেই ছিলে তো?
তা তো থাকবই। ডুন এক্সপ্রেস আসছে তখন। ঘরে অনেক লোক যে।
তা হলে হয়তো খেয়াল করেনি। এমনও হতে পারে তো?
তা পারে।
কিন্তু লোকটার হাবভাব দেখে মনে হল যে সে বলতে চায় যে সাধুবাবা বেরোলে সে নিশ্চয়ই দেখতে পেত। কিন্তু তা হলে সে সাধুবাবা গেলেন কোথায়?
স্টেশনে আর বেশিক্ষণ থেকে এ রহস্যের উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম।
এখানেও বাইরে টাঙ্গার লাইন, আর তারই একটাতে আমরা উঠে পড়লাম। টাঙ্গা জিনিসটাকে আর অবজ্ঞা করতে পারছিলাম না, কারণ সাতান্ন নম্বরের গাড়োয়ান আমাদের ঠিক সাত মিনিট সাতান্ন সেকেন্ডে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল।
এবারেও কিন্তু গাড়ি ছাড়বার পরে আমার মুখ থেকে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে পড়ল—
সাধুবাবা বাথরুমে গিয়ে ভ্যানিস করে গেল?
ফেলুদা দাঁতের ফাঁক দিয়ে ছিক্ করে খানিকটা পানের পিক রাস্তায় ফেলে দিয়ে বলল, তা হতে পারে। আগেকার দিনে তো সাধুসন্ন্যাসীদের ভ্যানিস-ট্যানিস করার ক্ষমতা ছিল বলে শুনেছি।
বুঝলাম ফেলুদা কথাটা সিরিয়াসলি বলছে না, যদিও ওর মুখ দেখে সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই।
স্টেশনের গেট ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই একটা ব্যান্ডের আওয়াজ পেলাম। ভোল্পর ভোল্পর ভোঁপুর ভোল্পর.আওয়াজট এগিয়ে আসছে।
তারপর দেখলাম আমাদেরই মতো একটা টাঙ্গা, কিন্তু সেটার গায়ে কাগজের ফুল, বেলুন, ফ্ল্যাগ—এই সব দিয়ে খুব সাজানো হয়েছে। বাজনাটা বাজছে একটা লাউডস্পিকারে, আর একটা রঙিন কাগজের গাধার টুপি পর লোক গাড়ির ভিতর থেকে গোছা গোছা করে কী একটা ছাপানো কাগজ রাস্তার লোকের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে।
ফেলুদা বলল, হিন্দি ফিল্মের বিজ্ঞাপন।
সত্যিই তাই। গাড়িটা আরেকটু কাছে আসতেই রংচঙে ছবি আঁকা বিজ্ঞাপনের বোর্ডটা দেখতে পেলাম। ছবির নাম ‘ডাকু মনসুর।’
হ্যান্ডবিলের দু-একটা আমাদের গাড়ির ভিতর এসে পড়ল, আর ঠিক সেই সময় একটা দলপাকানো সাদা কাগজ বেশ জোরে গাড়ির মধ্যে এসে ফেলুদার বুক পকেটে লেগে গাড়ির মেঝেতে পড়ল।
আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, লোকটাকে দেখেছি ফেলুদা! কাবলিওয়ালার পোশাক, কিন্তু—
আমার কথা শেষ হল না। ফেলুদা চট করে কাগজটা তুলে নিয়ে একলাফে চলন্ত টাঙ্গ থেকে রাস্তায় নেমে পাই পাই করে যে দিকে লোকটাকে দেখা গিয়েছিল সেইদিকে ছুটে গেল। ভিড়ের মধ্যে কলিশন বাঁচিয়ে একটা মানুষ কত স্পিডে ছুটতে পারে সেটা এই প্রথম দেখলাম।
এর মধ্যে অবিশ্যি টাঙ্গাওয়ালা গাড়ি থামিয়েছে। আমি আর কী করব? অপেক্ষা করে রয়েছি। ব্যান্ডের আওয়াজ ক্রমশ মিলিয়ে আসছে, তবে রাস্তায় কতগুলো বাচ্চা বাচ্চা ছেলে এখনও হ্যান্ডবিল কুড়োচ্ছে। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এসে গাড়োয়ানকে ইশারা করে চালানোর হুকুম দিয়ে এক লাফে গাড়িতে উঠে ধপ্র করে সিটে বসে পড়ে ফেলুদা বলল, নতুন জায়গাতে অলিগলিগুলো জানা নেই, তাই বাবাজি রক্ষে পেয়ে গেলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি লোকটাকে দেখেছিলে?
তুই দেখলি, আর আমি দেখব না?
আমি আর কিছু বললাম না। ফেলুদা লোকটাকে না দেখে থাকলে আমি ওকে বলতাম যে যদিও লোকটার গায়ে কাবলিওয়ালার পোশাক ছিল, কিন্তু অত কম লম্বা কাবলিওয়ালা আমি কখনও দেখিনি।
ফেলুদা এবার পকেট থেকে দল পাকানো কাগজটা খুলে হাত দিয়ে ঘষে সমান করে, চোখের খুব কাছে নিয়ে তার মধ্যে যে লেখাটা ছিল সেটা পড়ে ফেলল। তারপর সেটাকে তিনভাঁজ করে ওর মানিব্যাগের ভিতর নিয়ে নিল লেখাটা যে কী ছিল সেটা আর আমার জিজ্ঞেস করার সাহস হল না।
বাড়ি ফিরে দেখি ধীরুকাকার সঙ্গে শ্রীবাস্তব এসেছেন। শ্রীবাস্তবকে দেখে মনে হল না যে আংটিটা যাওয়াতে তাঁর খুব একটা দুঃখ হয়েছে। তিনি বললেন, উ আংটি ছিল অপয়া। যার কাছে যাবে তারই দুশ্চিন্তা হোবে, বিপদ হোবে, বাড়িতে ডাকু আসবে। আপনি তো লাকি, ধীরুবাবু। ধরুন যদি ডাকু এসে ঝামেলা করত, গোলাগোলি চালাতো?
ধীরুকাকা একটু হেসে বললেন, তা হলে তবু একটা মানে হত। এ যে একেবারে ভাঁওতা দিয়ে বুদ্ধ বানিয়ে জিনিসটা নিয়ে চলে গেল। এটা যেন কিছুতেই হজম করতে পারছি না।
শ্ৰীবাস্তব বললেন, আপনি কেন ভাবছেন ধীরুবারু। আংটি আমার কাছে থাকলেও যেত, আপনার কাছে থাকলেও যেত। আর আপনি যে বলেছিলেন পুলিশে খবর দেবেন—তাও করবেন না। ওতে আপনার বিপদ আরও বেড়ে যাবে। যারা চুরি করল, তারা খেপে গিয়ে ফির আপনাদের উপর হামলা করবে।