ফেলুদা দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে সোজা বাগানের দিকে ছুটছে। আমরাও তার পিছু নিলাম; লালমোহনবাবু এতক্ষণ পুকুরের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইছিলেন। তিনিও দেখলাম সঙ্গে সঙ্গে দিলেন ছুট।
তিনটে টর্চের আলোর সাহায্যে আমরা বাগানে গিয়ে পৌঁছলাম! ফেলুদা এগিয়ে গেছে, সে পশ্চিমের পাঁচিলের গায়ে একটা ধসে যাওয়া অংশের পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে টর্চ ফেলে রয়েছে।কাউকে দেখলেন? জীবনবাবু প্রশ্ন করলেন।
দেখলাম, কিন্তু চেনার মতো স্পষ্ট নয়।
আধঘণ্টা ধরে মশার বিনবিনুনি আর কামড় আর বিঝির কান ফাটানো শব্দের মধ্যে সারা বাগান চষে যেটা পাওয়া গেল সেটা একটা চরম রহস্য। সেটা হল বাগানের উত্তর দিকের শেষ মাথায় একটা গাছের গুড়ির পাশে একটা সদখোঁড়া গর্ত। তার মধ্যে যে কী ছিল বা কী থাকতে পারে সে ব্যাপারে জীবনবাবু কোনওরকম আলোকপাত করতে পারলেন না। লালমোহনবাবু অবিশ্যি সোজাসুজি বললেন গুপ্তধন, কিন্তু জীবনবাবু বললেন তাঁদের বংশে কস্মিনকালেও গুপ্তধন সম্বন্ধে কোনও কিংবদন্তি ছিল না। ফেলুদা যে কথাটা বলল সেটাও আমার কাছে পুরোপুরি রহস্য।
জীবনবাবু, আমার মনে হচ্ছে আমরা এই ঘটনাটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
আমরা কিছুক্ষণ হল খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের ঘরে এসে বসেছি। আজ বেশ কাহিল। লাগছে; বুঝতে পারছি। অন্ধকারে বনবাদাড়ে ঘোরাটা সহজ কাজ নয়। আমার আর লালমোহনবাবুর পায়ে বেশ কয়েক জায়গায় ডেটল দিতে হয়েছে। কারণ আগাছার মধ্যে কাঁটা-ঝোপও ছিল বেশ কয়েকটা।
একমাত্র ফেলুদাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মধ্যে কোনও পরিবর্তন নেই। সে আজ তার খাতা খুলেছে। গায়ে ওডোমস লাগিয়ে বালিশে বুক দিয়ে শুয়ে কী যেন হিজিবিজি লিখছে। লালমোহনবাবু একটা হাই অর্ধেক তুলে থেমে গেলেন, কারণ ফেলুদা একটা প্রশ্ন করেছে—লালমোহনবাবুকে নয়, তুলসীবাবুকে। তুলসীবাবু আমাদের জন্য পান নিয়ে ঢুকছেন।
তুলসীবাবু, আপনি যদি একজন মহৎ লোককে একটা লোক ঠকানো ফন্দি বাতলে দেন, সে-লোক যদি সে ফন্দি কাজে লাগায়, তা হলে তাকে কি আর মহৎ বলা চলে?
তুলসীবাবু ভ্যাবাচ্যাক ভাব করে বললেন, ওরে বাবা, আমি মশাই এসব হেঁয়ালি-টেয়ালিতে একেবারেই অপটু। তবে হ্যাঁ, মহৎ লোক অত নীচে নামবেন কেন? নিশ্চয়ই নামবেন না।
যাক, বলল ফেলুদা, আমি খুশি হলাম জেনে যে আপনি আমার সঙ্গে এক মত।
একেই তো প্যাঁচালো রহস্য, সেটাকে ধোঁয়াটে কথা বলে ফেলুদা আরও পেচিয়ে দিচ্ছে, আমি তাই ও নিয়ে আর একদম চিন্তা না করে মশারির ভিতর ঢুকলাম। কিন্তু চিন্তা করব না। ভাবলেই কি আর মন থেকে চিন্তা পালিয়ে যায়? আমার নিজের, মনেই যে প্রশ্ন জমা হয়েছে একগাদা। শ্যামলালবাবুর পায়ে কাদা কেন? কে পাঠিয়েছে ঠগীর ফাঁস আর হুমকি চিঠি? ঠাকুমা কাকে দেখে চেঁচালেন আজকে? বাগানের গর্তে কী ছিল? আত্মার উত্তর লেখা কাগজ দেখালেন না কেন মল্লিকমশাই?…গতকালের মতো আজও বিছানায় পড়তে না পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কেবল তফাতটা এই যে গতকাল এক ঘুমে রাত কাবার, আর আজ চোখ খুলে দেখি তখনও অন্ধকার।
আসলে ঘুমটা ভেঙেছে একটা চিৎকারে। সেটার জন্য দায়ী বোধহয় লালমোহনবাবু, কারণ তিনি খাটের উপর বসে আছেন মশারির বাইরে, সামনের খোলা জানালার গরাদের ভিতর দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখের উপর, আর স্পষ্ট দেখছি তাঁর চোখ গোল হয়ে গেছে।
বাপুরে বাপ, কী স্বপ্ন, কী স্বপ্ন! বললেন লালমোহনবাবু।
কী দেখলেন আবার? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
দেখলুম। আমার ঠাকুরদা। হরিমোহন গাঙ্গুলীকে.একটা সংবর্ধনা সভা, তাতে ঠাকুরদা। স্পিচ দিলেন, তারপর আমার গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, এই দ্যাখ, কেমন রোমাঞ্চকর মালা দিলাম তোকে—আর আমি দেখছি সেটা ফুলের মালা নয় তপেশ, সেটা—ওরেব্বাসরে বাস্-সেটা খুদে খুদে রক্তবর্ণ নরমুণ্ড দিয়ে গাঁথা!
এমন চমৎকার ব্রাহ্ম মুহূর্তে আপনি এই সব উদ্ভট স্বপ্ন দেখছেন?
আশ্চর্য! ফেলুদা যে তার খাটে নেই সেটা এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। সে ছাতের দরজা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলা; বুঝলাম সে যোগব্যায়াম করছিল। যাক, তা হলে সকাল হয়ে গেছে।
কী করব বলুন, বললেন লালমোহনবাবু, আপনার ওই রক্তকরণ আর আত্মারাম আর সংবর্ধনা মিলে এমন জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে আমার মধ্যে।
আমরা উঠে পড়লাম; তুলসীবাবু কি এখনও ঘুমোচ্ছেন? ছাতে এসে দেখি পুব দিকটা সবে ফরসা হয়েছে, তার ফলে চাঁদের আলোটা ফিকে লাগছে। দু-তিনটে তারা এখনও পিট্-পিটু করছে, কিন্তু তাদের মেয়াদও আর বেশিক্ষণ নয়। দাঁতন দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করব বলে কিছু নিমের ডাল ভেঙে রেখেছিলাম-ফেলুদা বলে দোকানের যে কোনও টুথব্রাশ আর পেস্টের চেয়ে দশ গুণ বেশি ভাল—তারই একটা চিবিয়ে রেডি করছি, এমন সময় শুনলাম পরিত্ৰাহি চিৎকার।
মিত্তির মশাই! মিত্তির মশাই!
ভোলানাথবাবুর গলা। আমরা দুদ্দাড় করে নীচে গিয়ে হাজির হলাম। সর্বনাশ হয়ে গেছে!
ভোরের আকাশে ভদ্রলোকের ফ্যাকাসে মুখ আরও ফ্যাকাশে লাগছিল। কী হয়েছে? ফেলুদা দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল।
কাল রাত্তিরে বাড়িতে ডাকাত পড়ে সব লণ্ডভণ্ড। সিন্দুক খালি! কতমশাইয়ের হাত-পা-মুখ বেঁধে রেখেছিল। আমাকেও বেঁধেছিল, সকালে ছোটবাবু এসে খুলে দিলেন। আপনি শিগগির আসুন!
০৫. শ্যামলাল মল্লিক জখম হননি বটে
শ্যামলাল মল্লিক জখম হননি বটে, কিন্তু তাঁকে যেভাবে দুঘণ্টা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়েছিল তাতে তিনি বেশ, টসকে গেছেন। ফ্যালফ্যাল করে সামনের দিকে চেয়ে বসে আছেন ফরাসের উপর, কেবল একবার মাত্র বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, বাঁধলি যদি তো মেরে ফেললি না কেন? এদিকে তাঁর সিন্দুক যে ফাঁক সেটা কি তিনি খেয়াল করেছেন?