বাগানটা অবিশ্যি ফুলের বাগান নয়, এখানে বেশির ভাগই বড় বড় গাছ আর ফলের গাছ। ফেলুদা ঘুরে ঘুরে কী দেখছে তা ওই জানে! একবার এক জায়গায় থেমে মাটিটার দিকে যেন একটু বেশিক্ষণ ধরে দেখল। এরই ফাঁকে আবার মল্লিকবাড়ির দোতলার পিছনের বারান্দা থেকে কে রে, কে ওখানে? বলে জীবনবাবুর ঠাকুমা চেঁচিয়ে উঠলেন। তাতে জীবনবাবুকে আবার উলটে চেঁচিয়ে বলতে হল, কেউ না ঠাকুমা-আমরা। ও, তোরা, উত্তর দিলেন ঠাকুম, আমি রোজই যেন দেখি কারা ঘুরঘুর করে ওখানে।
আপনার ঠাকুমার দৃষ্টিশক্তি কেমন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
খুবই কম, বললেন জীবনবাবু, এবং তার সঙ্গে মানানসই শ্রবণশক্তি!
বাগান এমনিতে তেমন দেখাশোনা হয় না?
ওই ভোলানাথবাবুই যা দেখেন।
রাত্রে লোক থাকে। এদিকে?
রাত্রে? মাথা খারাপ! রাত জেগে বাগানে টহল দেবে এরা?
সদর দরজায় তালা দেওয়া থাকে আশা করি?
ওটা ভোলানাথবাবুর ডিউটি! তবে আমি থাকলে আমিই চাবি বন্ধ করি, চাবি আমার কাছেই থাকে।
ভোলানাথবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়নি; তাঁকে একবার ডাকতে পারেন!
ভোলানাথবাবুকে দিনের আলোয় দেখে মনে হল তিনি শহুরে লোকের মতো ধুতি শার্ট পরলেও তাঁর চেহারায় এখনও অনেকখানি তাঁর পূর্বপুরুষের ছাপ রয়ে গেছে। খালি গা করে মাঠে নিয়ে, হাতে লাঙল ধরিয়ে দিলে খুব বেমানান হবে না। আমরা বাড়ির সামনে বাঁধানো পুকুরের ঘাটে বসে কথা বললাম। বর্ষার জলে পুকুর প্রায় কানায় কানায় ভরে আছে আর সারা পুকুর ছেয়ে আছে। শালুকে। নবীন বলে একটি চাকরকে লেবুর সরবত আনতে বললেন জীবনবাবু! চারিদিক অদ্ভুত রকম নিস্তব্ধ, কেবল দূরে কেখেকে জানি চি চি করে শোনা যাচ্ছে ট্রানজিস্টারে গান। ওটা না হলে সত্যিই যেন মনে হত আমরা কোন আদ্যিকালে ফিরে গেছি।
মৃগাঙ্কবাবু আপনাদের বাড়িতে একবারই এসেছেন? ভোলানাথবাবুকে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
সম্প্রতি একবারই এসেছেন।
আমার আগে?
আগেও এসেছেন। কয়েকবার। কাটোয়া থেকে আষাঢ় মাসে মদন গোসাঁইর দল এল, তখন মৃগাঙ্কবাবুই তাদের নিয়ে এসে কতাঁকে কোত্তন শুনিয়ে যান। এমনিতেও বার কয়েক একা আসতে দেখেছি; মনে হয়। কিন্তর্গ একটা কুষ্ঠি ছকে দেবার কথা বলেছিলেন।
সে কুষ্ঠি হয়েছে?
আজ্ঞে তা বলতে পারব না।
এবার যে এলেন, তার ব্যবস্থা কে করল?
আজ্ঞে কর্তার নিজেরই ইচ্ছা ছিল, আর কবিরেজ মশাইও বললেন, আর-আজ্ঞে, আমিও বলেছিলাম।
আপনার তো যাতায়াত আছে ভটচায বাড়িতে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ভক্তি হয়?
ভোলানাথবাবুর মাথা হেঁট হয়ে গেল। আজ্ঞে কী আর বলব বলুন। আমার মেয়ের নাম ছিল লক্ষ্মী, যেমন নাম তেমনি মেয়ে, এগারোয় পড়তে না পড়তে ওলাউঠেীয় চলে গেল। মৃগাঙ্কবাবু শুনে বললেন, সে কেমন আছে জানতে চাও তার নিজের কথায়?
ভোলানাথবাবু অন্ধকারে ধুতির খুঁটে চোখ মুছলেন। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, সেই মেয়েকে নামিয়ে আনলেন ভট্টচাষ মশাই! মেয়ে বললে ভগবানের কোলে সে সুখে আছে, তার কোনও কষ্ট নাই! মুখে বললে না। অবিশ্যি, কাগজে লেখা হল। সেই থেকে…
ভোলানাথবাবুর গলা আবার ধরে গেল। ফেলুদা ব্যাপারটাকে আর না বাড়িয়ে বলল, এ বাড়িতে আত্মা নামানোর সময় আপনি ছিলেন?
ছিলাম, তবে ঘরের মধ্যে ছিলাম না, দরজার বাইরে। ভেতরে কেবল কতামশাই আর ভটচাষ মশাই আর নিত্যানন্দ ছাড়া কেউ ছিলেন না। মা ঠাকরুন যেন জানতে না পারেন। এইটে বলে দিয়েছিলেন কর্তামশাই, তাই দরজায় পাহারা থাকতে হল।
তা হলে আপনি কিছুই শোনেননি?
আজ্ঞে দশ মিনিট খানেক চুপচাপের পর মধু সরকারের বাঁশ বনের দিক থেকে যখন শেয়াল ডেকে উঠল। সেই সময় যেন কতামশাইয়ের গলায় শুনলাম।–কেউ এলেন, কেউ এলেন? তারপর আর কিছু শুনিনি। সব হয়ে যাবার পর ভটচার্য মশাইকে নিয়ে তাঁর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
সরবত খাওয়া শেষ করে একটা চারমিনার ধরিয়ে ফেলুদা বলল, দুর্লভ মল্লিকের লোক আপনাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল সে কথা মনে পড়ে?
ভোলানাথবাবুর উত্তর এল ছোট্ট দুটো কথায়।
তা পড়ে।
আপনার মনে আক্রোশ নেই?
ফেলুদাকে এ ধরনের ধাক্কা-মারা প্রশ্ন করতে আগেও দেখেছি। ও বলে এই ধরনের প্রশ্নের রিঅ্যাকশন থেকে নাকি অনেক কিছু জানা যায়। ভোলানাথবাবু জিভ কেটে মাথা হেঁট করলেন। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, এখন মাথাটা ঠিক নেই। তাই, নইলে কতাৰ্মশাইয়ের মতো মানুষ কজন হয়?
ফেলুদা আর কোনও প্রশ্ন করল না। ভোলানাথবাবু একটুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, যদি অনুমতি দেন-আমি একটু ভটচার্য মশাইয়ের বাড়ি যাব।
ফেলুদা বা জীবনবাবুর কোনও আপত্তি নেই জেনে ভদ্রলোক চলে গেলেন। জীবনবাবু একটু উস্খুস্ করছেন দেখে ফেলুদা বলল, কিছু বলবেন কি?
আপনি কিছুটা অগ্রসর হলেন কি না জানার আগ্রহ হচ্ছে।
বুঝলাম ভদ্রলোক নিজের সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তিত।
ফেলুদা বলল, ভোলানাথবাবুকে বেশ ভাল লাগল।
জীবনবাবুর মুখ শুকিয়ে গেল। তার মানে আপনি বলতে চান—
আমি নিশ্চয়ই বলতে চাই না আপনাকে আমার ভাল লাগে না। আমি বলতে চাই শুধু দু-একটা খটকার উপর নির্ভর করে তো খুব বেশি দূর এগোনো যায় না-বিশেষ করে সেই খটকাগুলোর সঙ্গে যখন মূল ব্যাপারটার কোনও সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে না। এখন যেটা দরকার সেটা হল কোনও একটা ঘটনা যেটা—
কে রে, কে ওখানে?
ফেলুদার কথা থেমে গেল, কারণ ঠাকুমা চেঁচিয়ে উঠেছেন। আওয়াজটা এসেছে বাড়ির পিছন দিক থেকে। চারদিক নিস্তব্ধ বলে গলা এত পরিষ্কার শোনা গেল।