ওঁর পেশাটা কী বলুন তো! তুলসীবাবু ফেলুদার দিকে দেখিয়ে প্রশ্নটা করলেন। ইতিমধ্যে একজন বাইরের লোক এসে ঢুকেছে, তার সামনে ফেলুদা যে গোয়েন্দা এই খবরটা বেরিয়ে পড়লে মোটেই ভাল হবে না।
সেটা আর বলার দরকার নেই, বলল ফেলুদা। তুলসীবাবুও নিজের অসাবধানতার ব্যাপারটা বুঝে ফেলে জিভা কেটে কথা ঘুরিয়ে বললেন, শুকুরবার আরেকবার আপনার এখানে নিয়ে আসবা ওঁদের। আজ কেবল দর্শনটা করিয়ে গেলাম।
মৃগাঙ্কবাবুর চোখ এখনও ফেলুদার দিকে। একটু হেসে বললেন, সূক্ষ্ম সাল শস্যের কাজে এসেছেন। আপনি, এ কথা বললে আপনি ছাড়া আর কেউ বুঝবে কি? আপনি অকারণে বিচলিত হচ্ছেন।
ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে ফেলুদা বলল, চতুর লোক। এর পাসার জামবে না তো কার জমবে?
সূক্ষ্ম সাল শস্য কী মশাই? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। সন্ধ্যা শশী বন্ধু তো তাও অনেক কষ্টে বুঝলাম–তাও আপনি নিজের নামটা বললেন বলে।
সূক্ষ্ম হল অণু, সাল-দস্ত্য সা-হল সন, আর শস্য হল ধান। তিনে মিলে—
অনুসন্ধান! লালমোহনবাবু ক্ল্যাপ দিয়ে বলে উঠলেন, লোকটা শুধু গণনা জানে না, হেঁয়ালিও জানে। আশ্চর্য!
কে যেন এদিকেই আসছে-হাতের লণ্ঠনটা দোলার ফলে তার নিজের ছায়াটা সারা রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে এগিয়ে আসছে; তুলসীবাবু হাতের টর্চ তুলে তার মুখে ফেলে বললেন, ভট্টচাযের ওখানে বুঝি? কী ব্যাপার, ঘন ঘন দৰ্শন?
ভদ্রলোক একটু হেঁ হেঁ ভাব করে কিছু না বলে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
ভোলানাথবাবু বললেন তুলসীবাবু, ভটচার্য মশাইয়ের লেটেস্ট ভক্ত। মাঝে এক’দিন ওঁর বাড়িতে গিয়ে কার জানি আত্মা নামিয়েছেন।
রাত্রে তুলসীবাবুর দাওয়ায় বসে তিনরকম তরকারি, মুগের ডাল আর ডিমের ডালনা দিয়ে দিব্যি ভোজ হল। তুলসীবাবু বললেন যে এখানকার টিউবওয়েলের জলটায় নাকি খুব খিদে হয়।
খাওয়া-দাওয়া করে বাইরের দাওয়ায় বসে তুলসীবাবুর কাছে ওঁর মাস্টারি জীবনের গল্প শুনে যখন দোতলায় শুতে এলাম। তখন ঘড়ি বলছে সাড়ে নটা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মাঝরাত্তির। আমরা মশারি সমেত বিছানাপত্ৰ সব নিয়ে এসেছিলাম; ফেলুদা বলল ওডোমস মেখে শোব, মশারির দরকার নেই। আমি লক্ষ করেছি। গত দেড় ঘণ্টায় ও একবার কেবল গঙ্গার রান্নার প্রশংসা ছাড়া আর কোনও কথা বলেনি। এত চট করে ওকে চিন্তায় ডুবে যেতে এর আগে কখনও দেখিনি। লালমোহনবাবু বললেন ওঁর সংবর্ধনার স্পিচটা তৈরি করে রাখতে হবে, তাই উনি একটা লণ্ঠন চেয়েছেন, কারণ ঘরে বাতি জ্বলিয়ে রাখলে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে।
আমি বিছানায় শুয়ে ফেলুদাকে একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না।
তোমার নাম আর পেশ কী করে বলে দিল বলো তো?
আমার মনের অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে ওটাও একটা রে তোপ্সে। তবে অনেক লোকের অনেক পিকিউলার ক্ষমতা থাকে যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
লালমোহনবাবু বললেন, আমাকে এভাবে স্রেফ ইগনোর করল কেন বলুন তো।
সারা গাঁয়ের লোক আপনাকে অভ্যর্থনা দিতে চলেছে, আর একটি লোক আপনার নামে হেঁয়ালি বাঁধল না বলে আপনি মুষড়ে পড়লেন?
তা হলে বোধহয় আমার নাম থেকে হেঁয়ালি হয় না তাই।
ফেলুদা দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলল, রক্তকরণ মুগ্ধকরণ নদীপাশে যাহা বিঁধিলে
মরণ-কেমন হল?
কীরকম, কীরকম? বলে উঠলেন লালমোহনবাবু। ফেলুদা এত ফস করে ছড়াটা বলেছে যে দুজনের কেউই ঠিকমত ধরতে পারিনি। ফেলুদা আবার বলল-রক্তবরণ মুগ্ধকরণ নদীপাশে যাহা বিঁধিলে মরণ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান…রক্তবরণ লাল, আর মুগ্ধকরণ–
মোহন! আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম।
ইয়েস, লালমোহন-কিন্তু গাঙ্গুলী?-ওহা, নদী হল গাঙ আর গুলি বিধিলে মরণ–ওঃ, ব্রিলিয়ান্ট মশাই! কী করে যে আপনার মাথায় এত আসে জানি না! আপনি থাকতে সংবর্ধনাটা আমাকে দেওয়ার কোনও মানেই হয় না। ভাল কথা, স্পিচটা তৈরি হলে একটু দেখে দেবেন তো?
০৪. গ্রামটা ঘুরে দেখে
পরদিন সকালে গ্রামটা ঘুরে দেখে আমরা জাগরণী ক্লাবের বাড়িতে সিরাজদ্দৌলা নাটকের রিহাশািল দেখতে গেলাম; ফেলুদা অভিনেতাদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের ক্যানেডিয়ান থিয়েটার সম্বন্ধে একটা ছোটখাটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। সেখানেই আলাপ হল গোসাঁইপুরের একমাত্র মূকাভিনেতা বেণীমাধবের সঙ্গে। বললেন শুকুরবার বিকেলে আমাদের বাড়িতে এসে তাঁর আর্ট দেখিয়ে যাবেন! দেখবেন স্যার, ফ্ল্যাট ছাতের উপর সিঁড়ি বেয়ে ওঠা দেখিয়ে দেব, ঝড়ের মধ্যে মানুষের অভিব্যক্তি কীরকম হয়, স্যাড় থেকে ছরকম চেঞ্জের মধ্যে দিয়ে হ্যাঁপিতে নিয়ে যাওয়া সব দেখিয়ে দেব।
বিকেলে সেগুনহাটির মেলা দেখতে গেলাম। সেখানে নাগরদোলায় চড়ে, চা চিকেন কাটলেট আর রাজভোগ খেয়ে স্পাইডার লেডির বীভৎস ভেলকি দেখে, সাড়ে তেরো টাকার খুচরো জিনিস কিনে গোসাঁইপুর যখন ফিরলাম তখন ছটা বাজে। আকাশে আলো আছে দেখেই বোধহয় ফেলুদা বলল একবার মল্লিকবাড়িতে জীবনবাবুর সঙ্গে দেখা করে যাবে। তুলসীবাবু বললেন বাড়ি গিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।
সদর দরজায় পৌঁছানোর আগেই জীবনবাবু বেরিয়ে এলেন; বললেন ওঁর ঘরের জানালা দিয়েই অনেক আগেই আমাদের দেখতে পেয়েছেন। তারপর ফেলুদার প্রশ্নের উত্তরে বললেন যে নতুন কোনও খবর নেই।আপনাদের বাগানটা একটু দেখতে পারি? নিশ্চয়ই, বললেন জীবনবাবু, আসুন আমার সঙ্গে।