সেটা হলে মন্দ হত না।
সামান্য কাঁটা ল্যাম্প-লণ্ঠনের আলোয় এত বড় বাড়ির অনেকখানি যে অন্ধকার থেকে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কী? সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় জীবনবাবু পকেট থেকে ছোট্ট একটা টর্চ বার করে জ্বেলে বললেন, এটাও লুকিয়ে আনা।
শ্যমলাল মল্লিক তাঁর নিজের ঘরে ফরাসে বসে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গড়গড়ার নল হাতে নিয়ে বসে আছেন। জীবনবাবু আর নীচের ছবির দুর্লভবাবু, এই দুজনের সঙ্গেই ভদ্রলোকের চেহারার মিল আছে। হয়তো এই চেহারায় দুর্লভ সিংহের গোঁফ জুড়ে দিলে এঁকেও ডাকসাইটে বলে মনে হয়। এই অবস্থায় দেখে ভয় করে না, যদিও কথা বললে গলার গভীর স্বরে মনে হয় রাগালে ভয়ংকর হতে পারে।
আপনি এবার আসুন, গভীর গলায় বললেন শ্যামলালবাবু। যাকে কথাটা বলা হল তিনি ফরাসের এক কোণে বসে ছিলেন। জীবনবাবু তাকে কবিরাজ তারক চক্রবর্তী বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রোগ ডিগডিগে চেহারা, ঘন ভুরুর নীচে নাকের উপর পুরু কাচের চশমা, নাকের নীচে একজোড়া পুরু গোঁফ। তারক চক্রবর্তী নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
গোয়েন্দা দিয়ে কী হবে? শ্যামলাল মল্লিক ফেলুদার পরিচয় পেয়েই বিরক্তভাবে প্রশ্ন করলেন। এই চক্রান্তের কিনারা গোয়েন্দার কম্মো নয়। আমার শত্রু আমার ঘরেই আছে। এ কথা দুর্লভ মল্লিকের আত্মা বলে দিয়েছেন। সে কথা কাগজে লেখা আছে আমার কাছে। আত্মা ত্রিকালজ্ঞ। জ্যািন্ত মানুষ সাহেবি কেতাব পড়ে তার চেয়ে বেশি জানবে কী করে?
জীবনবাবু দেখলাম কথাটা শুনে কেমন জানি থতমত খেয়ে গেলেন। বুঝলাম তিনি ঘটনাটা জানেন না।
আপনি কি মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের বাড়িতে গিয়েছিলেন?
আমি যাব কেন? সে এসেছিল। আমি তাকে ডেকেছিলাম। আমাকে এইভাবে বিব্রত করছে কে সেটা আমার জানার ছিল। এখন জেনেছি।
জীবনবাবু গভীরভাবে বললেন, কবে এসেছিলেন মৃগাঙ্কবাবু?
তুমি আসার আগের দিন।
কই, তুমি তো আমাকে বলনি।
শ্যামলালবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি কথার ফাঁকে ফাঁকে সমানে গড়গড়া টেনে চলেছেন। ফেলুদা বলল, দুর্লভ মল্লিকের আত্মা কী লিখে গেছেন সেটা দেখা যায় কি?
ভদ্রলোক মুখ থেকে গড়গড়ার নল সরিয়ে লাল চোখ করে ফেলুদার দিকে চাইলেন।
তোমার বয়স কত হল?
ফেলুদা বয়স বলল।
এই বয়সে এত আস্পর্ধা হয় কী করে? সে লেখার আধ্যাত্মিক মূল্য জানা তুমি? সেটা কি যাকে-তাকে দেখাবার জিনিস?
আমায় মাপ করবেন, ফেলুদা খুব শান্তভাবেই বলল, আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম আপনার সংকট থেকে কোনও মুক্তির উপায় আপনার পরলোকগত পিতা বলেছেন কি না।
সেটার জন্য কাগজটা দেখাবার কী দরকার? আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। মুক্তির উপায় একটাই—শক্রকে বিদায় করো।
কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপ। তারপর ধীরকণ্ঠে জীবনলাল বললেন, তুমি তা হলে আমায় চলে যেতে বলছি?
আমি কি তোমাকে আসতে বলেছি কোনওদিন?
জীবনবাবু দেখলাম ছাড়বার পাত্র নন। বললেন, বাবা, তুমি আমার চেয়ে ভোলানাথবাবুর উপর বেশি আস্থা রাখছি, বোধহয় তার পরিবারিক ইতিহাসটা ভুলে যাচ্ছ। ভোলানাথবাবুর বাবা খাজনা দিতে দেরি করায় দুর্লভ মল্লিকের লোক গিয়ে তাঁর ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। আর–
মূর্খ! মল্লিকমশাই দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলেন।ভোলানাথ তখন ছিল শিশু। ঘটনার যাট বছরে সে প্রতিশোধ নেবে। আমাকে হত্যা করে? এমন কথা শুনলে লোকে হাসবে সেটা বুঝতে পারছি না?
আমরা আর বসলাম না; চলুন, আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি, বাইরে এসে বললেন জীবনবাবু।আপনারা শর্টকাট চিনে ফিরতে পারবেন না।
ফটিক থেকে বেরিয়ে এসে ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে ডেকে এনে আমি ঝামেলার মধ্যে ফেলতে চাইনি। আপনাকে যে-ভাবে অপমানিত হতে হল তার জন্য আমি অত্যন্ত লজ্জিত!
গোয়েন্দাদের এ সব ব্যাপারে লজ্জাবোধ থাকে না জীবনবাবু, বলল ফেলুদা।এখানে এসে আমার আদৌ আপশোঁস হচ্ছে না। এ নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন না। আমার কেবল আপনার সম্বন্ধেই ভাবনা হচ্ছে। একটা কথা আপনার বোঝা উচিত; হুমকি চিঠি পড়ে ভোলানাথবাবুর কথা মনে হচ্ছে বলেই কিন্তু সন্দেহটা আরও বেশি করে আপনার উপর পড়ছে।
কিন্তু গামছা আর চিঠি যখন আসে তখন তো আমি কলকাতায়, মিস্টার মিত্তির।
ফেলুদা একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বলল, আপনার যে কোনও অনুচর নেই গোসাঁইপুরে সেটা কী করে জানব জীবনবাবু?
আপনিও আমাকে সন্দেহ করছেন? শুকনো ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন জীবনবাবু।
আমি এখনও কাউকেই সন্দেহ করছি না, কাউকেই নিদোষ ভাবছি না। তবে একটা কথা আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। ভোলানাথবাবু কীরকম লোক?
জীবনবাবু এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, অত্যন্ত বিশ্বস্ত। এটা স্বীকার না করে উপায় নেই। কিন্তু তাই বলেই কি আমার উপর সন্দেহ পড়বে? শেষ প্রশ্নটা মরিয়া হয়ে করলেন জীবনবাবু। ফেলুদা বলল, জীবনবাবু, এখন আমাকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। এবং আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। এ ছাড়া আপনারও উপায় নেই। অপরাধীকে রক্ষা করার রাস্তা আমার জানা নেই। কিন্তু যে নিদোষ তাকে আমি বাঁচাবই।
এতে জীবনবাবু আশ্বস্ত হলেন কি না সেটা অন্ধকারে তাঁর মুখ না দেখে বোঝা গেল না।
বাঁশবনটা ফুরিয়ে আসার মুখে ফেলুদা একটা প্রশ্ন করল জীবনবাবুকে।
আপনার বাবা তো খড়ম ব্যবহার করেন; খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করেন কি কখনও—বাড়ির বাইরে?