মাঝ রাত্তিরে বাবার ঘরের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল কেউ।
কবে?
আমি আসার কয়েক’দিন আগে।
এত পাহারা সত্ত্বেও এটা হয় কী করে?
পাহারা? জীবনবাবু হেসে উঠলেন।পাহারা তো শুধু পোশাকের বাহারে মশাই, মানুষগুলো তো সব গেয়া ভূত, কুঁড়ের হৃদ। আর তারাও তো বুঝতে পারে বাবুর ভীমরতি ধরেছে। কাজ যা করে সে তো শুধু নাম কা ওয়াস্তে। নেহাত বাড়িতে ডাকাত পড়েনি। তাই, নইলে বোঝা যেত কার দৌড় কতদূর।
এ বাড়িতে আর কে কে থাকেন জানতে পারি কি?
বাবা ছাড়া আর আছেন আমার বিধবা ঠাকুমা। তিনি প্রাচীন আমলের লোক তাই দিব্যি আছেন। তা ছাড়া আছেন ভোলানাথবাবু। একে বাজার সরকার বলতে পারেন, ম্যানেজার বলতে পারেন— বাবার ফাইফরমাশ খাটা, দেখাশোনা করা, সবই ইনি করেন। বাবার অসুখ-বিসুখ হলে কবিরাজ ডাকতে হয়, সেটিও ইনিই করেন। কোনও কাজে শহরে যাবার দরকার হলেও ইনিই যান। ব্যস-এ ছাড়া আর কেউ নেই। অবিশ্যি চাকর আছে; একটি রান্নার লোক, দুটি দারোয়ান, একটি এমনি চাকর-এর বাড়িতেই থাকে। পালকির লোক আর পাঙখাওয়ালা কাছেই গ্রাম থেকে আসে।
এই ভোলানাথবাবু কোথাকার লোক? ক’দিন আছেন?
উনি এই গ্রামেরই লোক। আমাদের প্রজা ছিলেন। বাপ-ঠাকুরদা চাষবাস করত। ভোলাবাবু নিজে ইস্কুলে পড়েছেন, বেশ বুদ্ধিমান ছেলে ছিলেন। এখন বয়স ষাটের কাছাকাছি।
উনি কি আপনার পিতামহ?
ফেলুদা দেয়ালে একটা ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করল। বিরাট এক জোড়া পাকানো গোঁফ নিয়ে এক জমিদার বাঁ হাত শ্বেত পাথরের টেবিলের উপর রেখে ডান হাতে একটা রূপোয় বাঁধানো লাঠি ধরে চেয়ারে বসে আছেন। দেখলেই মনে হয় যাকে বলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ।
হ্যাঁ, উনিই দুর্লভ সিংহ।
যাঁর নামে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত?
জীবনবাবু হেসে উঠলেন।
বাঘ অবিশ্যি এককালে থাকলেও, ঠাকুরদার আমলে ছিল না; তবে হ্যাঁ, ডাকসাইটে জমিদার ছিলেন ঠিকই। এবং শেমফুলি অত্যাচারী।
একজন চাকর একটা ট্রেতে করে একটা পেয়ালা আর দুটো গেলাসে কী যেন নিয়ে এল।
তা হলে চায়ের পাট উঠিয়ে দেননি আপনার বাবা?
আলবত দিয়েছেন। এটা অবিশ্যি চা না, কফি। আমার নিজের একটি কাপ এবং একটিন নেসক্যাফে আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসি। সকল সন্ধে একতলায় বসে খাই। তাই আপনাদের জন্য গেলাস; কিছু মনে করবেন না।
মনে করব কেন? এ তো খাঁটি মাদ্রাজি সিসটেম। কোমলা বিলাসে এইভাবে কাসার পাত্রে খেয়েছি। কফি।
দোতলা থেকে মাঝে মাঝেই একটা খটাস খটাস শব্দ পাচ্ছিলাম; সেটা যে কীসের শব্দ সেটা ফেলুদার প্রশ্ন থেকে বুঝতে পারলাম।
আপনার বাবা বুঝি খড়ম ব্যবহার করেন?
জীবনবাবু একটু হেসে বললেন, সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?
এই ঠগীর গামছা ছাড়া আর কী থেকে আপনার ধারণা হল যে আপনার বাবার জীবন বিপন্ন?
জীবনবাবু এবার তাঁর পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে ফেলুদাকে দিলেন। তাতে গোটা গোটা পেনসিালের অক্ষরে লেখা–
তোমার পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তোমার প্রাণদণ্ডের আদেশ হইল। অতএব প্রস্তুত থাকো?
এটা এসেছে ৫ই অক্টোবর, আমি আসার আগের দিন। পোস্ট করা হয়েছিল কাটায়া থেকে। এখান থেকে যে-কেউ গিয়ে ডাকে ফেলে আসতে পারে।
কিছু মনে করবেন না–পূর্বপুরুষের পাপটা কী সে ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করতে পারলে সুবিধে হত।
বুঝতেই তো পারছেন, বললেন জীবনবাবু, একটা জমিদার বংশের ইতিহাসে অন্যায়ের তো কতরকম দৃষ্টান্ত থাকতে পারে। কোন পাপের কথা বলছে সেটা কী করে বলি বলুন! আমার ঠাকুরদাদা দুর্লভ মল্লিকই তো কতরকম অত্যাচার করেছেন প্রজাদের উপর।
এটা পেয়ে পুলিশে খবর দিলেন না কেন?
দুটো কারণে, একটু ভেবে বললেন জীবনবাবু। এক, এখানে আপনাকে কেউ চিনবে না, তাই যে-লোক হুমকি দিচ্ছে সে সাবধানতা অবলম্বন করার অতটা তাগিদ অনুভব করবে: না। দুই, পুলিশ এলে প্রথমে আমাকে সন্দেহ করবে।
আমরা দুজনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলাম ভদ্রলোকের দিকে। জীবনবাবু বলে চললেন, বাবার এই অদ্ভুত পরিবর্তনের পর থেকে আমার সঙ্গে তাঁর আর কনিবনা নেই। আমরা শহুরে মানুষ, বিজ্ঞানের অবদানগুলো অত সহজে বর্জন করা আমাদের চলে না মশাই। এটা ঠিক যে ইলেকট্রিক শকের ফলে বাবা মানসিক শকও পেয়েছিলেন সাংঘাতিক। ঘটনাটা ঘটে পাঁচ বছর আগে। আমি আর বাবা আপিস থেকে ফিরে একসঙ্গে বৈঠকখানায় ঢুকি। অন্ধকারে বাতি জ্বালতে গিয়ে সুইচবোর্ডে একটা খোলা তারে বাবার হাত আটকে যায়। বাইরেই ছিল মেইন সুইচ, আমি দৌড়ে গিয়ে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে অফ করি। তবু কেন জানি বাবার ধারণা হয় যে আমি ব্যাপারটা আরও তাড়াতাড়ি করতে পারতাম। সেই তখন থেকেই। যাই হাক, এখানে এলেই কথা কাটাকাটি হয়। একবার তো রেগে গিয়ে একটা জ্বলন্ত কেরোসিনের ল্যাম্প ছুড়ে ফেলে দিই। তার ফলে ফরাসে আগুন-টাগুন ধরে হুলুস্কুল ব্যাপার। পাড়াগাঁতে খবরটা রটে যায়। তারপর থেকে সবাই জানে শ্যাম মল্লিকের সঙ্গে তার ছেলের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। কাজেই বুঝতেই পারছেন কেন পুলিশ ডাকিনি। অবিশ্যি আপনাকে ডাকার আরেকটা কারণ হল আপনার খ্যাতি। আর আমার বিশ্বাস একজন আধুনিক শহুরে লোক সমস্যাটা আরও ভাল বুঝতে পারবে।
নেসক্যাফে শেষ হবার আগেই ঘরে ল্যাম্প চলে এসেছে। ওপরে পাঁচালিও বন্ধ হয়েছে। জীবনবাবু বললেন, আপনি বাবার সঙ্গে কি একবার দেখা করতে চান?