কেন বলুন তো?
একবার আত্মারামবাবুর ওখানে আপনাকে নিয়ে যেতে চাই। উনি গোসাঁইপুরের একটি অ্যাট্রাকশন।
আত্মারামবাবু?
আসল নাম অবিশ্যি মৃগেন ভটচায। আত্মা-টাত্মা নিয়ে চৰ্চা করেন। তাই এখানকার কয়েকজন নাম দিয়েছে আত্মারাম। আমি দিইনি কিন্তু! আমার ধারণা ভদ্রলোকের মধ্যে সত্যিই ইয়ে আছে।
আত্মা নিয়ে চাঁচটা যে কী সেটা আর জিজ্ঞেস করা হল না। কারণ ঠিক তখনই আবার দেখতে পেলাম পালকিটাকে। আমরা বাইরের দাওয়ায় বসে চা-চিড়ে খাচ্ছিলাম, সামনেই রাস্তা, আর সেই রাস্তা দিয়েই পালকিটা আসছে। এবার দেখতে পেলাম যে ভিতরে একজন লোক বসে আছে।
ভদ্রলোক পালকির দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি মারছিলেন। বেহারিাগুলো ঠিক গল্পে যেরকম পড়া যায় সেইভাবে হুমাহাম শব্দ করতে করতে এগোচ্ছিল, এমন সময় শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পালকিটাও থেমে গেল।
পালকি মাটিতে নামতেই, তার ভিতর থেকে একজন বছর পয়ত্ৰিশের ভদ্রলোক বেশ কষ্ট করে বাইরে বেরিয়ে আরও খানিকটা কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালেন। সমস্ত ব্যাপারটা বেমানান, কারণ ভদ্রলোকের স্মার্ট কলকাতিয়া চেহারা, গায়ে বুশ শার্ট আর টেরিলিনের প্যান্ট।
মিস্টার মিত্তির? ফেলুদার দিকে এগিয়ে এসে হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমার নাম জীবনলাল মল্লিক।
বুঝেছি। ইনি আমার বন্ধু মিস্টার গাঙ্গুলী, আর এ হল আমার খুড়তুতো ভাই তপেশ। তুলসীবাবুর সঙ্গে বোধহয় আপনার পরিচয় আছে।
আমার নাম জীবনলাল মল্লিক।
তুলসীবাবুর সঙ্গে বোধহয় আপনার পরিচয় আছে!
জীবনবাবু পালকিটাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমার বাড়ি মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। আসবেন একবারটি? আপনাদের চা খাওয়া হয়েছে? একটু কথা ছিল।
লালমোহনবাবু রয়ে গেলেন, আমি আর ফেলুদা ভদ্রলোকের সঙ্গে মল্লিকবাড়ি রওনা দিলাম। রাস্তা ছেড়ে একটা বাঁশ বনে ঢুকে বুঝলাম এটা শর্টকাট। জীবনবাবু বললেন, কলকাতায় একটা টেলিফোন করার দরকার ছিল, তাই স্টেশনে যেতে হল।
পালকি ছাড়া গতি নেই বুঝি?।
জীবনবাবু ফেলুদার দিকে আড়চাখে চেয়ে বললেন, আপনাকে তুলসীবাবু বলেছেন বুঝতে পারছি।
হ্যাঁ, বলছিলেন ইলেকট্রিক শকের পরিণাম।
পরিণামটা গোড়ায় এত ভয়াবহ ছিল না, আক্রোশটা ছিল, শুধু ইলেকট্রিসিটির বিরুদ্ধে। এখন কী দাঁড়িয়েছে সেটা আমাদের বাড়ি গেলেই বুঝতে পারবেন।
আপনি এখানে প্রায়ই আসেন?
দুমাসে একবার। আমাদের একটা ব্যবসা আছে, সেটা এখন আমাকেই দেখতে হয়। সেই নিয়ে কথা বলতেই আসি।
তা হলে ব্যবসায় এখনও ইন্টারেস্ট আছে আপনার বাবার?
মোটেই না। কিন্তু আমি সেটা চাই না। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। যাতে উনি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন।
কোনও আশা দেখছেন কি?
এখনও না।
০২. মল্লিক বাড়িও যে অনেক’দিনের পুরনো
মল্লিক বাড়িও যে অনেক’দিনের পুরনো সেটা বলে দিতে হয় না, তবে মেরামতের দরুন বাড়িটাকে আর পোড়ো বলা চলে না। প্রাসাদ না হলেও, অট্টালিকা নিশ্চয়ই বলা চলে এ বাড়িকে। ফটক দিয়ে ঢুকে ডাইনে একটা বাঁধানো পুকুর, বাড়ির দুপাশের ফাঁক দিয়ে পিছনে গাছপালা দেখে মনে হয়। ওদিকে একটা বাগান রয়েছে। পাঁচিলটা মেরামত হয়নি, তাই এখানে ওখানে ফাটল ধরেছে, কয়েক জায়গায় আবার দেয়াল ভেঙেও পড়েছে।
ফটকে একজন দারোয়ান দেখলাম যার হাতে সড়কি আর ঢাল দেখে মনে হল কোনও ঐতিহাসিক নাটকে নামার জন্য তৈরি হয়েছে। সদর দরজার পাশেই ঠিক ওই রকমই হাস্যকর পোশাক-পরা একজন বীরকন্দাজ জীবনবাবুকে দেখে এক পোল্লায় সেলাম ঠুকল। এই থমথমে পরিবেশেও এই ধরনের সব অবিশ্বাস্য ব্যাপার দেখে হাসি পাচ্ছিল।
আমরা একতলাতেই বৈঠকখানায় ফরাসের উপর বসলাম। ঘরে চেয়ার নেই। দেয়ালে যা ছবি আছে সবই হয় দেবদেবীর, না হয় পৌরাণিক ঘটনার। দেয়ালের আলমারির একটা তাকে গোটা দশেক বাংলা বই দেখলাম, বাকি তাকগুলো মনে হল খালি।
আপনাদের পাখা লাগবে কি? তা হলে দাসুকে লাগিয়ে দিই।
এতক্ষণ লক্ষ করিনি, এবার দেখলাম মাথার উপর ঝালরওয়ালা ডবল-মাদুর একটা কাঠের ডাণ্ডা থেকে ঝুলছে, আর ডাণ্ডাটা ঝুলছে সিলিং-এ দুটো আংটা থেকে। ডাণ্ডা থেকে দড়ি বেরিয়ে বার্ট দিকের একটা দরজার উপর দেয়াল ফুড়ে বারান্দায় চলে গেছে। এই হল টানা-পাখা, যেটা টানা হয় বারান্দা থেকে, আর হাওয়া হয়। ঘরে। অক্টোবর মাস, সন্ধে হয়ে এসেছে তাই গরম নেই; পাখার আর দরকার হল না।
এটা কী জানেন?
জীবনবাবু আলমরিটা খুলে তার থেকে একটা গামছা, টাইপের চারকোনা কাপড় বার করে ফেলুদাকে দেখালেন। সেটার বিশেষত্ব এই যে তার এককোণে গেরো দিয়ে বাঁধা রয়েছে একটা পাথরের টুকরো।
গামছাটা হাতে নিয়ে ফেলুদার ভুরু কুঁচকে গেল। সে পাথরের উল্টো দিকের কোনটা হাতে নিয়ে গামছাটাকে বার কয়েক শূন্যে ঘুরিয়ে বলল, তোপ্সে, উঠে দাঁড়া তো।
আমি দাঁড়ালাম আর সেই সঙ্গে ফেলুদাও দাঁড়াল আমার থেকে হাত তিনেক দূরে। তারপর গামছা হাওয়ায় ঘুরিয়ে হাতে ধরা অবস্থাতেই জাল ফেলার মতো করে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে পাথরের দিকটা আমার গলায় পেঁচিয়ে গেল।
ঠগী! আমি বলে উঠলাম।
ফেলুদাই বলেছিল এককালে আমাদের দেশে ঠগীদের দস্যুগিরির কথা। তারা ঠিক এইভাবে পথচারীদের গলায় ফাঁস দিয়ে হ্যাঁচকাটানে তাদের খুন করে সর্বস্ব লুট করে নিত।
ফেলুদা অবিশ্যি গামছা ধরে টান দেয়নি। সে তক্ষুনি পাঁচ খুলে নিয়ে ফরাসে বসে বলল, এ জিনিস আপনি কোথায় পেলেন?