ফেলুদা তাঁকে থামিয়ে বলল, দোষ আমি আপনাকে দিচ্ছি না তুলসীবাবু। আপনি তো আর নিজেকে মহৎ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন না। কিন্তু ইনি করেন। যাই হাক, এই ভণ্ডামির গন্ধ পেয়েই আমি কাগজটা পেতে বদ্ধপরিকর। আমার আশা ছিল শ্যামলালবাবু সম্পর্কে কয়েকটা খটকার উত্তর আমি এই কাগজে পাব।
পিন্দিমের আলোতেও বুঝতে পারলাম মৃগাঙ্কবাবুর কপাল ঘেমে গেছে। ফেলুদা কাগজটা আলোয় ধরে বলল, দুর্লভ মল্লিকের আত্মা এই কাগজে তাঁর ছেলের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্নগুলো মুখে করা হয়েছিল, তাই এতে লেখা নেই; কিন্তু উত্তরগুলো থেকে প্রশ্নগুলো অনুমান করা যায়। আমি উত্তরের পাশে পাশে সেগুলো লিখেছি, এবং সেই ভাবেই পড়ে শোনাচ্ছি; আমার ভুল হলে সংশোধন করে দেবেন মৃগাঙ্কবাবু!
মৃগাঙ্কবাবুর দ্রুত নিশ্বাসে প্রদীপের শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফেলুদা পড়া আরম্ভ করল—
এক নম্বর প্রশ্ন—আমার শত্রু কে? উত্তর—ঘরেই আছে।
সে কি আমার মৃত্যু কামনা করে—না। তবে কী চায়?—টাকা। টাকা রক্ষার উপায় কী?–সিন্দুকে রেখো না। কোথায় রাখব?—মাটির নীচে। কোনখানে?—বাগানে। বাগানের কোথায়?—উত্তরে। উত্তরে কোথায়?—আম গাছের নীচে। কোন আম গাছ?—দেয়ালের ফাটলের ধারে।
ফেলুদা এবার হাতের কাগজটা টেবিলের উপরে রেখে বলল, শ্যামলালবাবুর পায়ের তলায় মাটি এবং গায়ে মশার কামড় দেখে মনে হয়েছিল। তিনি কোনও কারণে বাগানে গিয়ে সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়েছেন। আজ জানি তিনি এই কাগজের— অর্থাৎ মৃগাঙ্কবাবুর-নির্দেশ অনুযায়ী সিন্দুক থেকে টাকার বাক্স বার করে মাটিতে পুঁতিতে গিয়েছিলেন। টাকা লুকিয়ে রাখার এই প্রাচীন পন্থা শ্যামলালবাবুর মনঃপূত হবে এটা মৃগাঙ্কবাবু বুঝেছিলেন। এই টাকার উপর মৃগাঙ্কবাবুর লোভ অনেক দিনের, কিন্তু বিশ্বস্ত ভোলানাথ যদ্দিন আছেন তদিন সিন্দুকের নাগাল পাওয়া অসম্ভব। প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন ভোলানাথবাবুর উপর শ্যামলালের সন্দেহ ফেলে তাকে হাঁটানোর। সেটা সফল হয়নি। কিন্তু সেই সময় আশ্চর্য সুযোগ এসে যায়। শ্যামলালবাবু নিজেই মৃগাঙ্কবাবুকে ডেকে পাঠান আত্মা নামানোর জন্য। মৃগাঙ্কবাবু তাঁর আশ্চর্য বুদ্ধি বলে এক টিলে দুই পাখি মারেন; শ্যামলালের ঘরের লোককেই শ্যামলালের শত্রু করে দেন, এবং টাকার বাক্স সিন্দুক থেকে বার করিয়ে বাগানে অন্যান। সেই বাক্স কাল সন্ধ্যাবেলা–
একটা শব্দ শুনে পিছন ফিরে দেখি ভাগনে বেঞ্চি ছেড়ে দরজার দিকে একটা লাফ মেরেছে। কিন্তু ঘর থেকে বেরোনো আর হল না। কারণ দুটো শক্ত হাত তাকে বাধা দিয়েছে। এবার হাতের মালিক ভাগনে সমেত ভিতরে ঢুকলেন। আরেব্বাস-এ যে সুধাকর দারোগা : দারোগ বললেন, বাক্সটা পেয়েছি মিস্টার মিত্তির; একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে কাপড়ের নীচে রাখা ছিল। মণীশ–দাও তো!
একজন কনস্টেবল একটা স্টিলের বাক্স নিয়ে ঘরে ঢুকে সেটাকে টেবিলের উপর রাখল।
এর ডালা তো ভেঙেই ফেলা হয়েছে দেখছি, বলল ফেলুদা।
বাক্স খুলতে লণ্ঠন আর পিন্দিমের আলোয় তাড়া তাড়া একশো টাকার নোট দেখেই বুঝলাম। এত টাকা আমি একসঙ্গে কখনও দেখিনি।
কিন্তু খুন? হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন মৃগাঙ্কবাবু।খুন করল কে? খুন তো আমি করিনি!
খুন একজনই করেছে মৃগাঙ্কবাবু!—ফেলুদার গলা যেন খাপখোলা তলোয়ার্ক্স—এবং তারও নাম প্রদোষ চন্দ্ৰ মিত্র। খুন হয়েছে। আপনার ভণ্ডামি, আপনার শয়তানি, আপনার লোভ। এর কোনওটাই আর কোনওদিনও মাথা তুলতে পারবে না, কারণ সকলেই জানবে যে আপনি আজ অপূর্ব ক্ষমতাবলে একটি জীবন্ত ব্যক্তির আত্মাকে পরলোক থেকে ডেকে এনেছেন আপনার এই ঘরে—আসুন, জীবনবাবু!
এবার পিছন নয়, সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলেন জীবনলাল মল্লিক। তাঁকে দেখেই মৃগাঙ্কবাবু যে কথাটা বলে আর্তনাদ করলেন, সেটা লালমোহনবাবুর বিশ্বাস হা হতোহস্মি, কিন্তু আমি যেন শুনলাম হায়! হাতে হাতকড়া।
***
অবিশ্যি হাতে হাতকড়া পড়েছিল ঠিকই। সুধাকরবাবু শুধু একটা অভিযোগ করলেন ফেলুদাকে—মিছিমিছি দুটো পুকুরে জাল ফেললেন আমাদের দিয়ে।
কী বলছেন সুধাকরবাবু, বলল ফেলুদা,জীবনবাবু খুন হয়েছে। এ ধারণা সকলের মনে বদ্ধমূল না হলে মৃগাঙ্কবাবুর ভণ্ডামি হাতেনাতে ধরব কী করে?
জীবনবাবু খুনের ব্যাপারটা শুধুই মৃগাঙ্কবাবুকে সায়েস্তা করার জন্য। একেবারে প্ল্যান করে ভাঁওতা। এদিকে আমি আর ফেলুদা, আর ওদিকে লালমোহনবাবু ও ভোলানাথবাবু চলে যাওয়া মাত্র ভদ্রলোক বাগান থেকে উঠে বাড়িতে ফিরে গিয়ে দোতলার পিছন দিকের একটা গুন্দোম ঘরে গা ঢাকা দেন। যাবার পথে ঠাকুমা দেখে ফেলেছিলেন, কিন্তু সেটা ফেলুদা ম্যানেজ করে। আজ সন্ধ্যায় তিনি আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। মৃগাঙ্কবাবুর বৈঠকের শেষে আত্মপ্রকাশ করবেন বলে! সেই সময় বাঁশ বনে দূর থেকে আমাদের দেখে বাদুড়ে কালীমন্দিরে ঢুকে মড়া সেজে পড়ে থাকতে হয়।
রাত্রে খাবার সময় তুলসীবাবু কাঁচুমাচু ভাব করে ফেলুদাকে বললেন, আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হননি তো?
অসন্তুষ্ট? বলল ফেলুদা, আপনি আমাকে কতটা হেলপ করেছেন জানেন? লোকটা সেদিন আমার নাম নিয়ে হেঁয়ালি না করলে তো ওর ওপর আমার সন্দেহই পড়ত না! আমার তো আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।
আজ জীবনবাবু আমাদের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। বললেন, আমি বেক্সেবার আগে বাবাকে প্ৰণাম করে এলাম।