আপনি কী লিখছেন সেটা জানার জন্য সকলেরই কৌতুহল হবে, অথচ আমি ছাড়া আর সকলেই টেবিলের উলটা দিকে বসেছে, লেখা পড়া সম্ভব নয়। আমি যদি সকলের সুবিধের জন্য পড়ে দিই তাতে আপনার আপত্তি আছে কি?
কোনও আপত্তি নেই, বললেন মৃগাঙ্কবাবু, আপনি স্বচ্ছন্দেই লেখা পড়ে শুনিয়ে দিতে পারেন। আপনার জিজ্ঞাস্য তো একটাই, নয় কি?
তিনটে-ডাকাতের পরিচয়, খুনির পরিচয় এবং কখন কী ভাবে খুনিটা হয়।
উত্তম, বললেন মৃগাঙ্কবাবু।
০৮. হাতে হাতকড়া
পাঁচ মিনিটের মধ্যেও তুলসীবাবু এলেন না দেখে মৃগাঙ্কবাবু কাজ আরম্ভ করে দেওয়া স্থির করলেন। মনে মনে বললাম।–তুলসীবাবু এ জিনিস অনেক দেখেছেন, তাঁর পুরোটা না দেখলেও চলবে।
অনুগ্রহ করে আপনাদিগের প্রত্যেকের হস্তদ্বয় অঙ্গুলি প্রসারিত করে এই টেবিলের উপর স্থাপন করুন।
কাঠের টেবিলে হাতগুলো রাখার সঙ্গে সঙ্গে যে একটা টক টক শব্দ শুরু হল সেটা আর কিছুই না, লালমোহনবাবুর কাঁপা আঙুল টেবিলের উপর তবলার বোল তুলে ফেলছে। ভদ্রলোক দাঁতে দাঁত চেপে হাত স্টেডি করলেন।
মৃগাঙ্কবাবুর চোখ বন্ধ, ঠোঁট নড়ছে। চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ বলেই বুঝলাম উনি ফিস ফিস করে একটা শ্লোক আওড়াচ্ছেন।
এক মিনিট পরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। এবারে যাকে ইংরিজিতে বলে ডেথলি সাইলেন্স। পিন্দিমের শিখা কাঁপছে, আর তার চার পাশে ঘুর ঘুর করছে তিনটে ফড়িং। ঘরের চারিদিকের দেয়ালে চারটে মানুষের ছায়া থর থর করে কাঁপছে। আড়চোখে ফেলুদার দিকে চেয়ে তার মনের অবস্থা কিছু বুঝতে পারলাম না। চায়াল শক্ত, চোখের পাতা প্ৰায় পড়ছেই না, দৃষ্টি সটান মৃগাঙ্কবাবুর দিকে। মৃগাঙ্কবাবু নিজে যেন পাথরের মূর্তি। এর মধ্যে কখন যে পেনসিলটা তার হাতে চলে গেছে জানি না। সেটা এখন খাতার সাদা পাতার উপর ধরা, শিসের ডগাটা ঠেকে রয়েছে। কাগজের সঙ্গে।
এবার মৃগাঙ্কবাবুর ঠোঁটে কাঁপুনি আরম্ভ হল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমার পাশে আবার তবলার বোল শুরু হয়েছে, এখন আওয়াজটা রীতিমতো ভৌতিক বলে মনে হচ্ছে। অনেকেরই এ অবস্থায় এভাবে হাত কাঁপতে পারে, যদিও আমার কাঁপছে শুধু বুক।
জীবনলাল, জীবনলাল, জীবনলাল…
তিনবার পর পর অতি আস্তে উচ্চারণ হল নামটা। মৃগাঙ্কবাবুর ঠোঁটটা নড়ল কি না তাও ভাল করে বুঝতে পারলাম না।এসেছেন? আপনি এসেছেন?
প্রশ্ন এল আমাদের চমকে দিয়ে আমাদের পিছন থেকে। এইবারে বুঝলাম নিত্যানন্দের ভূমিকাটা কী। মৃগাঙ্কবাবু নিজে এই অবস্থায় কথা বলেন না। হয়তো বলা সম্ভবই না। এসেছি।
ফেলুদার গলা। খাতায় লেখা হয়েছে ফেলুদা সেটাই পড়ে বলেছে।
আমার চোখ মৃগাঙ্কবাবু হাতের দিকে গেল। পিছন থেকে প্রশ্ন এল, তুমি কোথায় আছ?
কাছেই—পড়ে বলল ফেলুদা।
কতগুলি প্রশ্ন তোমাকে করা হবে, সেগুলোর জবাব দিতে পারবে? পেনসিল নাড়ল।
পারব—পড়ে বলল ফেলুদা।
সিন্দুক খুলে টাকা নিল কে? আমি।
তোমাকে যে হত্যা করল, তাকে দেখেছিলে? হ্যাঁ।
চিনেছিলে? হ্যাঁ।
কে সে? বাবা।
কিন্তু কী ভাবে খুনটা করা হল সেটা আর জানা হল না, কারণ প্রশ্নটা হবার সঙ্গে সঙ্গে এতেই হবে বলে ফেলুদা উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, তোপ্সে, ওই লণ্ঠনটা আন তো—দরজার বাইরে রাখা রয়েছে। আলো বড় কম।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা, লণ্ঠনটা এনে টেবিলের উপরে রাখলাম।
ফেলুদা মৃগাঙ্কবাবুর সামনে থেকে কাগজটা তুলে নিল। তারপর উত্তরগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, মৃগাঙ্কবাবু, আমার মনে হচ্ছে আপনার এই আত্মটি এখনও ঠিক ত্রিকালজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেনি, কারণ প্রশ্নোত্তরে কতগুলো গোলমাল পাচ্ছি।
মৃগাঙ্কবাবু কটমট করে ফেলুদার দিকে চাইলেন, যেন এক চাহনিতে ফেলুদাকে ভস্ম করবেন। ফেলুদা তাঁকে অগ্রহ করে বলে চলল, যেমন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সিন্দুক খুলে টাকা নিল কে, উত্তর হচ্ছে—আমি। কিন্তু সিন্দুকে তো টাকা ছিল না মৃগাঙ্কবাবু!
ম্যাজিকের মতো মৃগাঙ্কবাবুর মুখ থেকে ক্রোধের ভাবটা চলে গিয়ে সেখানে দেখা দিল সংশয়। ফেলুদা বলল, টাকা ছিল না বলছি। এই কারণে যে সিন্দুক খুলেছিল জীবনলাল নয়, খুলেছিল প্রদোষ চন্দ্ৰ মিত্ৰ। অবিশ্যি জীবনবাবু এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। তিনিই মাঝরাত্তিরে দরজা খুলে আমাকে ঢুকতে দেন, তিনিই বলে দেন যে তাঁর বাবার বালিশের তলায় থাকে সিন্দুকের চাবি; ভোলানাথবাবু আর শ্যামলালবাবুকে বাঁধার ব্যাপারেও অবিশ্যি তিনি আমাকে সাহায্য করেন। যাই হাক, সিন্দুকে টাকার বদলে যেটা ছিল সেটা হল–
ফেলুদা পকেট থেকে আর একটা কাগজ বের করল। এটাও খাতার কাগজ, এটাতেও পেনসিল দিয়ে লেখা।
এই কাগজটাই, বলল ফেলুদা, শ্যামলালবাবুর কাছ থেকে চেয়ে আমি পাইনি। এটার প্রয়োজন হয়েছিল। এই কারণেই যে মৃগাঙ্কবাবুর সততা সম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহ উপস্থিত হয়েছিল, আর সেটা হয়েছিল একেবারে প্রথম দিনের সাক্ষাতের পরেই। আমার সঙ্গে আলাপ হবার পরমুহূর্তেই তিনি ভান করলেন যে আমার নাম এবং পেশা তিনি অলৌকিক উপায়ে জেনে ফেলেছেন। আসলে এগুলো কিন্তু তাঁকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। তুলসীবাবু। তাই নয়, তুলসীবাবু?
তুলসীবাবু এর মধ্যে কখন যে অন্ধকারে ঘরে ঢুকে মোড়ায় বসেছেন তা দেখিইনি। ভদ্রলোক ফেলুদার কথায় ভারী অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে বললেন, মানে আপনার মনে, ইয়ে, যদি একটু ভক্তিভাব জাগে…