আমি জীবনবাবুর বন্ধু।
তোমাকে তো দেখিনি।
আমি দুদিন আগে এসেছি কলকাতা থেকে।
তুমিও কলকাতায় থাকো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কিছু বলার ছিল আপনার?
বুড়ি হঠাৎ যেন খেই হারিয়ে ফেললেন। ঘাড় উঁচু করে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক চেয়ে বললেন, কী বলার ছিল সে আর মনে নেই বাবা, আমার বড্ড ভোলা মন যে!
আমরা ঠাকুমাকে আর সময় দিলাম না। তিনজনে গিয়ে ঢুকলাম শ্যামলালবাবুর ঘরে।
রসিকবাবু ইতিমধ্যে এসে হাজির হয়েছেন; তিনি শ্যামলালবাবুর নাড়ি ধরে বসে আছেন।
জীবন কোথায় গেল? এখনও কেমন জানি অসহায় ভাব করে কথা বলছেন ভদ্রলোক। বুঝলাম রসিকবাবু জীবনবাবুর মৃত্যু সংবাদটা শ্যামলালবাবুকে দেননি।
আপনি তো চাইছিলেন তিনি কলকাতায় ফিরে যান, বলল ফেলুদা।
ও চলে গেল! কীসে গেল? পালকিতে?
পালকিতে তো আর সবটুকু যাওয়া যায় না। কাটায়া থেকে ট্রেন ছাড়া গতি নেই। গোরুর গাড়ি বা ডাক গাড়িতে যাওয়া আজকের দিনে যে সম্ভব নয় সেটা নিশ্চয়ই বোঝেন।
তুমি আমাকে বিদ্যুপ করছ? শ্যামলালবাবুর গলায় যেন একটু অভিমানের সুর।
শুধু আমি কেন? ফেলুদা বলল, গ্রামের সবাই করে। আপনি যা করছেন তাতে আপনার তো নয়ই, কারুরই লাভ বা মঙ্গল হচ্ছে না। আপনার নিজের কী হল সেটা তো দেখলেন। সড়কির বদলে বন্দুকধারী একজন ভাল পাহারাদার থাকলে আর এ কাণ্ডটা হত। না। বৈদ্যুতিক শক-এর চেয়ে এ শকটা কি কিছু কম হল? যে-যুগ চলে গেছে তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না মল্লিকমশাই।
আশ্চর্য, আমি ভেবেছিলাম ভদ্রলোক তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবেন, কিন্তু সেটা হল না।
ফেলুদার কথার উত্তরে একটি কথাও বললেন না। তিনি, কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন।
০৬. মুখের চেহারা কী হয়েছে
মুখের চেহারা কী হয়েছে দেখেছেন?
লালমোহনবাবু তক্তপোষে বসে হাতে তাঁর দাড়ি কামানোর আয়নাটা নিয়ে তাতে নিজের মুখ দেখে মন্তব্যটা করলেন। ওঁর মুখের যা অবস্থা, আমাদের সকলেরই তাই।
গোসাঁইপুরের ওই একটা ড্রব্যাক, বললেন তুলসীবাবু।এটার বিষয় আপনাদের আগে থেকেই ওয়ার্নিং দেওয়া উচিত ছিল।
আপনি গোসাঁইপুর বলছেন, আমি বলব মল্লিকবাড়ির বাগানে, বললেন লালমোহনবাবু। ওইটেই হল মশার ডিপো।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে আমরা দোতলায় আমাদের ঘরে এসে বসেছি। পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। ফেলুদা এভাবে গুম মেরে গেছে কেন বুঝতে পারছি না। আমার বিশ্বাস জীবনবাবুর খুনটা ওর কাছে এতই অপ্রত্যাশিত যে ওর ক্যালকুলেশন সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে। আর ডাকাতই যদি খুনটা করে থাকে, তা হলে তদন্তের মজাটা কোথায়? ডাকাত ধরার রাস্তা তো পুলিশের ঢের বেশি ভাল জানা আছে; সেখানে একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা আর কী করতে পারে?
দারোগী সুধাকর প্রমাণিক ইতিমধ্যে ফেলুদার সঙ্গে এসে কথা বলে গেছেন। তিনি ফেলুদার নাম শুনেছেন, তবে ফেলুদার উপর খুব একটা ভক্তিভাব আছে বলে মনে হল না। বিশেষ করে জীবনবাবুর লাশ লোপাট হয়ে যাওয়াতে তিনি রীতিমতো বিরক্ত।
আপনারা যাঁরা শখের ডিটেকটিভ, বললেন সুধাকর দারোগ, তাদের দেখেছি কাজের মধ্যে সিসটেমের কোনও বালাই নেই। আরেকজন দেখেছি আপনার মতো গণেশ দত্তগুপ্ত–তার সঙ্গে একটা কেসে ঠোকাঠুকি লাগে। যেখানে দরকার অ্যাকশনের, সেখানে চোখ কুঁচকে বসে ভাবছে। কী যে ভাবছে তা মা গঙ্গাই জানে। আবার যেখানে কাজ করছে, তার পেছনে কোনও চিন্তা নেই। লাশটা যখন দেখলেন পড়ে আছে, আর সেটাকে ছেড়ে যদি যেতেই হয় তো একটা লোককে পাহারায় বসিয়ে যেতে পারলেন না? এখন আমাদের ওই পেছনের পুকুরের জলে জাল ফেলতে হবে। আর তাতে যদি বডি না ওঠে তো ভেবে দেখুন–এই গাঁয়ে এগারোটা পুকুর, তার মধ্যে একটাকে দীঘি বলা চলে! আর তাতেও যদি না হয় তা হলে.এ সবই কিন্তু আপনার নেগলিজেন্সের জন্য।
ফেলুদা পুরো ঝালটা হজম করে উলটে একটা বেয়াড়া প্রশ্ন করে সুধাকর দারোগকে আরও উসকে দিল।
আপনি প্ৰেতাত্মায় বিশ্বাস করেন?
দারোগা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বললেন, আপনার সিরিয়াস বলে খ্যাতি আছে শুনেছিলুম, এখন দেখছি সেটাও ভুল।
ফেলুদা বলল, কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। কারণ আপনারা যদি খুনি ধরতে না পারেন তা হলে আমাকে মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি প্রেতাত্মা নামাতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে জীবনলালের আত্মাই জীবনলালের খুনির সঠিক সন্ধান দিতে পারেন।
আপনি নিজে তা হলে হাপলেস ফিল করছেন বলুন।
খুনের তদন্ত আমার সাধ্যের বাইরে সেটা স্বীকার করছি, বলল ফেলুদা, কিন্তু ডাকাতের হাতে হাতকড়া পরাতে পারব বলে আমার বিশ্বাস আছে।
সুধাকরবাবুর যে ফেলুদার উপর আস্থা কত কম সেটা তাঁর পরের কথা থেকেই বুঝতে পারলাম!
আপনি ডেড় বডি আয় জ্যাস্তু বডি তফাত করতে পারেন। আশা করি? গলায় ফাঁস দিয়ে টান মারলে কী কী পরিবর্তন হয় সেটা জানা আছে আপনার?
ফেলুদা ঠাণ্ডা ভাবেই উত্তরটা দিল।
সুধাকরবাবু, আমার যখন পুলিশে চাকরি নেবার কোনও বাসনা নেই, তখন আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়াটা আমার মর্জির ব্যাপার। পুলিশের উপর নির্ভর না করে যখন আমি প্রেতাত্মার কথা বলছি তখন বুঝতেই পারছেন আমার তদন্তের রাস্তাটা একটু স্বতন্ত্র।
ভোলানাথবাবু সম্পর্কে আপনার মনে কোনও সন্দেহের ভাব নেই?
নিশ্চয়ই আছে। আমার সন্দেহ হয় আপনারা দিগ্বিদিক বিবেচনা না করেই ভদ্রলোকের হাতে হাতকড়া পরাবেন, কারণ তাঁর পূর্বপুরুষ যে জীবনবাবুর পূর্বপুরুষের দ্বারা লাঞ্ছিত। হয়েছিলেন সে খবর হয়তো আপনাদের কানো পৌঁছেছে। কিন্তু সেটা করলে আপনারা মারাত্মক ভুল করবেন।