নরেনবাবু আছেন কি? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
তার তো অসুখ।
দেখা করতে পারবেন না? একটু দরকার ছিল।
কাকে চাই?
প্রশ্নটা এল চাকরের পিছন দিক দিয়ে। একজন চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের ভদ্রলোক এগিয়ে এসেছেন। ফরসা রং, চোখ সামান্য কটা, দাড়ি-গোঁফ কামানো। পাজামার উপর বুশ শার্ট, তার উপর একটা মটকার চাদর জড়ানো। ফেলুদা বলল, নরেন বিশ্বাস মশাই-এর একটা জিনিস তাঁকে ফেরত দিতে চাই। ওঁর মানিব্যাগ, পকেট থেকে পড়ে গোসল পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে।
তাই বুঝি? আমি ওঁর ভাই। আপনার ভিতরে আসুন। দাদা বিছানায়। এখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা। কথা বলছেন, তবে এ রকম অ্যাক্সিডেনটি…একটা বড় রকম ইয়ে তো।…
দোতলায় যাবার সিঁড়ির পিছন দিকে একটা বেডরুম, তাতেই নরেনবাবু শুয়ে আছেন। ভাইয়ের চেয়ে রং প্রায় দু-পোঁচ কালো, ঠোঁটের উপর বেশ একটা পুরু গোঁফ, আর মাথার ব্যান্ডেজটার নীচে যে টাক আছে সেটা বলে দিতে হয় না।
বাঁ হাতে ধরা স্টেটসম্যান কাগজটা নামিয়ে ভদ্রলোক ঘাড় হেঁট করে আমাদের নমস্কার জানালেন। ডান কবজিতে ব্যান্ডেজ, তাই হাত জোড় করে নমস্কারে অসুবিধা আছে। ভাইটি আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। শুনলাম চাকরকে হাঁক দিয়ে আরও দুটো চেয়ারের কথা বলে দিলেন। এ ঘরে রয়েছে একটিমাত্র চেয়ার, খাটের পাশে ডেস্কের সামনে।
ফেলুদা মানিব্যাগটা বার করে এগিয়ে দিল।
ও হা হা—অনেক ধন্যবাদ। আপনি আবার কষ্ট করে…
কষ্ট আর কী–ফেলুদা বিনয়ভূষণ–ঘটনাচক্রে ওখানে গিয়ে পড়েছিলাম, আমার এই বন্ধুটি কুড়িয়ে পেলেন, তাই…
নরেনবাবু এক হাতেই মানিব্যাগের খাপগুলো ফাঁক করে তার ভিতরে একবার চোখ বুলিয়ে ফেলুদার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। গোরস্থানে…?
আমিও আপনাকে ঠিক ওই প্রশ্নই করতে যাচ্ছিলাম, ফেলুদা হেসে বলল, আপনি বোধহয় প্রাচীন কলকাতার ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করছেন?
ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
করছিলাম তো বটেই–কিন্তু যা ঘা খেলাম। মনে হয় পবনদেব চাইছেন না। আমি এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করি।
বিচিত্ৰপত্ৰ কাগজে যে লেখাটা–
ওটা আমারই। মনুমেন্ট তো? আমারই। আরও লিখেছি। দু-একটা এখানে সেখানে। চাকরি করতাম, গত বছর রিটায়ার করেছি। কিছু তো একটা করতে হবে! ছাত্র ছিলাম ইতিহাসের। ছেলেবেলা থেকেই ওদিকটায় ঝোঁক। কলেজে থাকতে বাগবাজার থেকে হেঁটে দমদম যাই ক্লাইভ সাহেবের বাড়ি দেখতে। দেখেছেন? এই সেদিন অবধি ছিল–একতলা বাংলো টাইপের বাড়ি, সামনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোট-অফ-আর্মস।
আপনি প্রেসিডেন্সিতে পড়েছেন?
খাটের ডান পাশেই টেবিল, আর তার দু-হাত উপরেই দেয়ালে একটা বাঁধানো গ্রুপ ছবিতে লেখা—
Presidency College Alumni Association 1953.
শুধু আমি কেন, বললেন নরেন বিশ্বাস, আমার ছেলে, ভাই, বাপ, ঠাকুর্দাঁ সবাই প্রেসিডেন্সির ছাত্র। ওটা একটা ফ্যামিলি ট্রাডিশন। এখন বলতে লজ্জা করে–আমরা সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্ৰ–গিরীন, আমি, দুজনেই!
কেন, লজ্জা কেন!
কী আর করলুম বলুন জীবনে? আমি গেলাম চাকরিতে, গিরীন গেল ব্যবসায়। কে আর চিনল আমাদের বলুন?
ফেলুদা এগিয়ে গিয়েছিল। ছবিটা দেখতে। এবার তার দৃষ্টি নামল নীচের দিকে। টেবিলের উপর একটা নীল খাতা। সেটার প্রথম পাতাটা খোলা রয়েছে, দেখে বোঝা যাচ্ছে একটা লেখা শুরু হয়ে আট-দশ লাইনের বেশি এগোয়নি।
আপনার নাম কি নরেন্দ্ৰনাথ না নরেন্দ্রমোহন?
অ্যাজ্ঞে?
ভদ্রলোক বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। ফেলুদা আবার প্রশ্নটি করল। ভদ্রলোক একটু হেসে একটু যেন অবাক হয়ে বললেন, নরেন্দ্রনাথ বলেই তো জানি। কেন, আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে?
আপনার ভিজিটিং কার্ডে দেখলাম এন এম বিশ্বাস রয়েছে।
ও হো! ওটা তো ছাপার ভুল। কাউকে কার্ড দেবার আগে ওটা কলম দিয়ে শুধরে দিই। অবশ্য নতুন কার্ড ছাপিয়ে নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু গাফিলতি করে আর করিনি। আর সত্যি বলতে কী, আমাদের আর ভিজিটিং কার্ডের কী প্রয়োজন বলুন। ইদানীং মিউজিয়মটিউজিয়মের কতা-ব্যক্তিদের সঙ্গে একটু দেখা-টেখা করতে হচ্ছিল তাই ব্যাগে কয়েকটা ভরে নিয়েছিলাম। ভাল কথা-আপনিও কি ওই গোরস্থান নিয়ে লিখবেন-টিখবেন নাকি? আশা করি না! আপনার মতো ইয়াং রাইভ্যালের সঙ্গে কিন্তু পেরে উঠব না।
ফেলুদা যাবার জন্য উঠে পড়ে বলল, আমি লিখিটখি না–শুধু জেনেই আনন্দ। ভাল কথা-একটা অনুরোধ আছে। পুরনো কলকাতা নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে যদি গডউইন পরিবারের কোনও উল্লেখ পান তা হলে অনুগ্রহ করে জানালে উপকার হবে।
গডউইন পরিবার?
টমাস গডউইনের সমাধি পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে রয়েছে। ইন ফ্যাক্ট, একই গাছ একসঙ্গে আপনাকে এবং গডউইনের সমাধিকে জখম করেছে।
তাই বুঝি?
আর সার্কুলার রোড গোরস্থানে গডউইন পরিবারের আরও পাঁচটা সমাধি রয়েছে।
অবিশ্যি জানাব। কিন্তু কোথায় জানাব? আপনার ঠিকনাটা?
ফেলুদা তার প্রাইভেট ইনভেসটিগেটর লেখা কার্ডটা নরেনবাবুর হাতে তুলে দিল।
এই আপনার পেশা নাকি? গোয়েন্দাগিরি? ভদ্রলোক বেশ একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কলকাতায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ আছে বলে শুনেছি, কিন্তু চোখে দেখলাম এই প্রথম!
০৫. ভিক্টোরিয়ার কথাটা জিজ্ঞেস করলে
তুমি ভিক্টোরিয়ার কথাটা জিজ্ঞেস করলে না কেন? আমি ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলাম গাড়িতে চৌরঙ্গির দিকে যেতে যেতে। আজ লালমোহনবাবু ধরেছেন ব্ল ফক্সে গিয়েই চা-স্যান্ডউইচ। খাওয়াবেন। কে জানত যে এই বুফক্সে গিয়েই ঘটনার মোড় ঘুরে যাবে!