কাল যে নরেন বিশ্বাসের ব্যাগ থেকে একটা সাদা কাগঞ্জ বেরোল, তাতে কী লেখা ছিল?
নরেন বিশ্বাসের খাতাটা ফেলুদা বিকেলে ফেরত দিতে যাবে। সে খবর নিয়ে জেনেছে যে, ভদ্রলোক পার্ক হসপিটালে আছেন।
ফেলুদা তার খাতাটা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিল।
যদি এর মানে বার করতে পারিস তা হলে বুঝব নোবেল প্রাইজ তোর হাতের মুঠোয়।
খাতার রুল টানা পাতায় লেখা রয়েছে–
B/S 14 SNB for WG Victoria & P.C. (44?)
Re Victorias letters try MN, OU, GAA, S, WN
আমি মনে মনে বললাম, নোবেল প্ৰাইজটা ফসকে গেল। তাও মুখে বললাম, ভদ্রলোক কুইন ভিক্টোরিয়া সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড পি সি টা কী ঠিক বুঝতে পারছি না।
পি সি বোধ হয় প্রিন্স কনসার্ট, তার মানে ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট।
আর কিছুই বুঝতে পারছি না।
কেন, ফর মানে জন্য আর ট্রাই মানে চেষ্টা বুঝলি না?
ফেলুদার মেজাজ দেখে বুঝলাম সেও বিশেষ কিছু বোঝেনি। সিধু জ্যাঠার কথাটা যে আমারও মনে ধরেনি তা নয়। ফেলুদা সত্যিই হয়তো যেখানে রহস্য নেই। সেখানে জোর করে রহস্য ঢোকাচ্ছে। কিন্তু তার পরেই মনে পড়ে যাচ্ছে কালকের সেই জ্বলন্ত সিগারেটটা, আর সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভিতরটা কেমন যেন খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা আছি জেনে কে পালাল গোরস্থান থেকে? আর বাদলা দিনে সন্ধে করে সে সেখানে গিয়েছিলই বা কেন?
আগে থেকেই ঠিক ছিল যে চারটের সময় আমরা নরেন বিশ্বাসের ব্যাগ ফেরত দিতে যাব, আর লালমোহনবাবুই আমাদের এসে নিয়ে যাবেন। টাইমমাফিক বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ পেলাম। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন হাতে একটা পত্রিকা নিয়ে। কী বলেছিলুম মশাই? এই দেখুন বিচিত্ৰপত্র, আর এই দেখুন। নরেন বিশ্বাসের লেখা। সঙ্গে একটা ছবিও আছে মনুমেন্টের, যদিও ছাপেনি ভাল।
কিন্তু এও তো দেখছি, নরেন্দ্ৰনাথ বলছে, নরেন্দ্রমোহন তো নয়। তা হলে কি অন্য লোক নাকি?
আমার মনে হয় ভিজিটিং কার্ডেই গণ্ডগোল। বাজে প্রেসে ছাপানো। আর ভদ্রলোক হয়তো প্রুফও দেখেননি। কিন্তু ব্যাগের মধ্যে ওই কাটিং আর তার পর এই লেখা—ব্যাপারটা স্রেফ কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?
ফেলুদা লেখাটায় চোখ বুলিয়ে পত্রিকাটা পাশের টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে বলল, ভাষা মন্দ না, তবে নতুন কিছু নেই। এখন জানা দরকার এই লোকই গাছ পড়ে জখম হওয়া নরেন বিশ্বাস কি না।
পার্ক হসপিটালের ডাঃ শিকদারকে বাবা বেশ ভাল করে চেনেন। আমাদের বাড়িতেও এসেছেন দু-একবার, তাই ফেলুদার সঙ্গেও আলাপ। ফেলুদা কার্ড পাঠানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমাদের ডাক পড়ল।
কী ব্যাপার? কোনও নতুন কেস-টেস নাকি?
ফেলুদা যেখানেই যে-কারণেই যাক না কেন, চেনা লোক থাকলে তবে এ প্রশ্নটা শুনতেই হয়।
ও হেসে বলল, আমি এসেছি। এখানের এক পেশেন্টকে একটা জিনিস ফেরত দিতে।
কোন পেশেন্ট?
মিস্টার বিশ্বাস। নরেন বিশ্বাস। পরশু—
সে তো চলে গেছে! এই ঘণ্টা দু-এক আগে। তার ভাই এসেছিল গাড়ি নিয়ে; নিয়ে গেছে।
কিন্তু কাগজে যে লিখল—
কী লিখেছে? সিরিয়াস বলে লিখেছে তো? কাগজে ওরকম অনেক লেখে। আস্ত একটা গাছ মাথায় পড়লে কি আর সে লোক বাঁচে? একটা ছোট ডাল, যাকে বলে প্ৰশাখা, তাই পড়েছে। জখমের চেয়ে শকটাই বেশি। ডান কবজিটায় চোট পেয়েছে, মাথায় কটা, স্টিচ— ব্যাস এই তো।
আপনি কি বলতে পারেন ইনিই পুরনো কলকাতা নিয়ে—
ইয়েস। ইনিই। একটা লোক সন্ধেবেলা গোরস্থানে ঘোরাঘুরি করছে, ন্যাচারেলি কৌতুহল হয়। জিজ্ঞেস করতে বললেন পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করছেন। তা আমি বললুম ভাল লাইন বেছেছেন; নতুন কলকাতাকে যতটা দূরে সরিয়ে রাখা যায় ততই ভাল।
জখমটা স্বাভাবিক বলেই মনে হল?
অ্যাই!… পথে আসুন বাবা। এতক্ষণে একটা গোয়েন্দা মাক প্রশ্ন হয়েছে!
ফেলুদা অপ্ৰস্তুত ভাবটা চাপতে পারলে না।
মানে, উনি নিজেই বললেন যে গাছ পড়ে…?
আরো মশাই, গাছটা যে পড়েছে তাতে তো আর ভুল নেই? আর উনি সেখানেই ছিলেন।
সন্দেহ করার কোনও কারণ আছে কি?
উনি নিজে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু বলেননি তো?
মোটেই না। বললেন, চোখের সামনে দেখলাম গাছটা ভাঙল–তার ডালপালা যে কতখানি ছড়িয়ে আছে সেটা তো আর আঁচ করা সম্ভব হয়নি। তবে হ্যাঁ-ইয়েস-জ্ঞান হবার পরে উইল কথাটা দু-তিনবার উচ্চারণ করেছিলেন। এতে যদি কোনও রহস্য থাকে তো জানি না। মনে তো হয় না, কারণ উইলের উল্লেখ ওই একবারই; আর করেননি।
ভদ্রলোকের পুরো নামটা আপনার জানা আছে?
কেন, কাগজেই তো বেরিয়েছিল। নরেন্দ্ৰনাথ বিশ্বাস।
আরেকটা প্রশ্ন-বিরক্ত করছি, কিছু মনে করবেন না-ওনার পোশাকটা মনে আছে? বিলক্ষণ। শার্ট আর প্যান্ট। রংও মনে আছে-সাদা শার্ট আর বিস্কিটের রঙের প্যান্ট। গ্ল্যাক্সো না, ক্রিম ক্র্যাকার-হেঃ হেঃ!
ফেলুদা ডাঃ শিকদারের কাছে নরেন বিশ্বাসের ঠিকানা নিয়ে নিয়েছিল। আমরা নার্সিংহোম থেকে সটান চলে গেলাম নিউ আলিপুরে। ভারী ঝামেলা নিউ আলিপুরে ঠিকানা খুঁজে বার করা, কিন্তু জটায়ুর ড্রাইভার মশাইটি দেখলাম। কলকাতার রাস্তাঘাট ভালই চেনেন। বাড়ি বার করতে তিন মিনিটের বেশি ঘুরতে হয়নি।
দোতলা বাড়ি, দেখে মনে হয় পনেরো থেকে বিশ বছরের মধ্যে বয়স! গেটের সামনে রাস্তার উপর একটা কালো অ্যামবাসাডর দাঁড়িয়ে আছে, আর গেটের গায়ে দুটো নাম—এন বিশ্বাস ও জি বিশ্বাস। বেল টিপতে একজন চাকর এসে দরজা খুলে দিল।