গিরীনবাবু চুপ! বোঝাই যাচ্ছে ফেলুদা ঠিকই বলেছে।
আপনার দাদা আপনাকে কী বলে ডাকেন, মিঃ বিশ্বাস?
তাতে আপনার কী প্রয়োজন?
আপনি যখন বলবেন না, তখন আমিই বলছি। উইল উইল বলে ডাকেন আপনার দাদা। হাসপাতালে জ্ঞান হবার পর তিনি আপনারই নাম উচ্চারণ করেছিলেন। দুবার–তাই না?
এবার ফেলুদা লাল খামটা থেকে একটা বড় ছবি টেনে বার করল।দেখুন তো গিরীনবাবু এদের চেনেন কি না! এ ছবি হয়তো আপনাদের বাড়িতেও নেই। কিন্তু বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ডে ছিল।
স্বামী-স্ত্রীর ছবি; যাকে বলে ওয়েডিং গ্রুপ; ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে গিরীনবাবুর চেহারার আশ্চর্য মিল! আর ভদ্রমহিলা মেমসাহেব।
ফেলুদা বলল, চিনতে পারছেন। এঁদের? ইনি হচ্ছেন পাৰ্বতীচরণ–অর্থাৎ পি সি বিশ্বাস, আপনার প্রপিতামহ। ইনি যে ক্রিশ্চান হয়েছিলেন সেটা তো এর পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর এই মহিলাটি হচ্ছেন টমাস গডউইনের নাতনি-ওই চিঠিটা যিনি লিখেছেন তিনিভিক্টোরিয়া গডউইন। এর কুমারী অবস্থার ছবিও বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ডে রয়েছে। এই ভিক্টোরিয়া আপনার প্রপিতামহের মতো একজন নেটিভ ক্রিশচীনকে ভালবেসে তার ঠাকুরদাদার বিরাগভাজন হয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় টম গডউইন ভিক্টোরিয়াকে ক্ষমা করে যান। তার এক বছর পরেই পাৰ্বতীচরণ ভিক্টোরিয়াকে বিয়ে করেন। তার মানে হচ্ছে এই যে, কলকাতায় একটি নয়, দুটি পরিবারের সঙ্গে টম গডউইনের নাম জড়িত রয়েছে-একটি রিপন লেনে, আরেকটি নিউ আলিপুরে। আর আশ্চর্য এই যে, দুজনের কাছেই এমন দলিল রয়েছে যাতে টমাসের ঘড়ির উল্লেখ রয়েছে। এক হল ভিক্টোরিয়ার এই চিঠি, আর আরেক হল টমাসের মেয়ে শার্লট গডউইনের ডায়রি।
আশ্চর্য ঘটনা! গল্পকে হার মানায়। ভিক্টোরিয়ার লেখা চিঠির একটা তাড়া বহুকাল থেকে নাকি নরেনবাবুদের বাড়িতে রয়েছে। পুরনো। ট্রাঙ্কের মধ্যে, কিন্তু কেউ গরজ করে পড়েনি। পুরনো কলকাতা নিয়ে লিখতে শুরু করার পর নরেনবাবু চিঠিগুলো পড়েন। তখনই টমাস গডউইনের ঘড়ির ঘটনাটা জানতে পারেন, আর ভাইকে সে সম্বন্ধে বলেন।
গিরীনবাবু ফেলুদার জেরার ঠেলায় কাহিল, কিন্তু এখনও তাকে রেহাই দেবার সময় আসেনি। ফেলুদা হঠাৎ প্রশ্ন করল–
আপনার কি রেসের মাঠে যাবার অভ্যোস আছে, মিঃ বিশ্বাস?
ভদ্রলোক কিছু বলার আগে মিঃ চৌধুরী খোঁকিয়ে উঠলেন।
আমার কাছ থেকে টাকা আগাম নিয়ে সব ঘোড়ার পিছনে খুইয়েছে, আর এখন কবর খুঁড়ে কুককেলভির ঘড়ি এনে হাজির করেছে।–অকৰ্মা কোথাকার!
ফেলুদা চৌধুরীর কথায় কান না দিয়ে গিরীনবাবুকেই উদ্দেশ করে বলে চলল, তার মানে টম গডউইনের একটি গুণ আপনি পেয়েছেন!! আর সেই কারণেই বোধহয় এত বড় একটা ঝুকি নিয়েছিলেন?
উত্তরটা এল বেশ ঝাঁজের সঙ্গে।
মিঃ মিত্তির, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে, একশো বছর পেরিয়ে গেলে কবরের ভিতরের কোনও জিনিসের উপর কোনও ব্যক্তিবিশেষের আর কোনও অধিকার থাকে না। ওই ঘড়িটা এখন আর টম গডউইনের সম্পত্তি নয়।
সেটা জানি মিঃ বিশ্বাস। ও ঘড়ি সরকারের সম্পত্তি, আপনারও নয়। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, আপনার অপরাধ তো শুধু ঘড়ি চুরির চেষ্টা নয়, অন্য অপরাধও যে আছে।
কী অপরাধ? গিরীন বিশ্বাস এখনও একগুয়ে ভাব করে চেয়ে আছেন ফেলুদার দিকে।
এবার ফেলুদা তার পকেট থেকে ছোট্ট একটা জিনিস বার করল।
দেখি তো, এই বোতামটা আপনার ওই কোটটা থেকেই পড়েছে কি না-যে কোটটা আপনি এই দুদিন আগে হংকং লক্তি থেকে নিয়ে এলেন।
ফেলুদা বোতাম নিয়ে এগিয়ে গেল।
এই দেখুন, মিলে যাচ্ছে।
তাতে কী প্রমাণ হল? প্রশ্ন করলেন গিরীনবাবু।এটা খুলে পড়ে যায় গোরস্থানে। আমি তো অস্বীকার করছি না যে সেখানে গিয়েছিলাম।
আমি যদি বলি এটা আপনার কোট নয়, আপনার দাদার কোট, তা হলে স্বীকার করবেন কি?
কী আবোল-তাবোল বকছেন আপনি?
আকোল-তাবোল আমি বকিছি না, মিঃ বিশ্বাস, আপনি বকছেন। কাল আমার বাড়িতে এসে বকেছেন, আবার এখানে বকছেন। এ কোিট আপনার দাদার। এটা পরে তিনি গোরস্থানে গিয়েছিলেন। সেই ঝড়ের দিন। গিয়ে দেখেন গ নর কবর খোঁড়া হচ্ছে, আপনি রয়েছেন। তিনি আপনাকে বাধা দিতে যান। আপনি তার মাথায় বাড়ি মারেন-কলাঠি বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে। নরেনবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আপনি হয়তো তাকে মেরেই ফেলতেন, কিন্তু সেই সময় ঝড়টা আসে। আপনি পালাতে যান। গাছ পড়ে–
গিরীনবাবু আবার বাধা দিলেন।
আমার দাদাকে আপনি মিথ্যেবাদী বানাতে চান? তিনি বলেছেন তাঁর মাথায় গাছের ডাল–
কিন্তু ফেলুদার কথা আটকানো এখন সহজ নয়। সে বলেই চলল—
গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আপনার পিঠে। আপনার গায়ে কোট ছিল না। পিঠের জখম ঢাকবার জন্য আপনি দাদার কোটি খুলে নিজে পরেন। কেটের বোতাম ছিঁড়ে যায়, পকেট থেকে। মানিব্যাগ পড়ে যায়। আপনার নিজের পকেট থেকে রেসের বই—
গিরীনবাবু আবার পালাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। এবার ফেলুদাই তাঁকে ধরে তাঁর কোটটা খুলে দিয়ে দেখিয়ে দিল তাঁর টেরিলিনের শার্টের নীচে ব্যান্ডেজটা।
আপনার দাদা আপনাকে বাঁচাবার জন্য অনেক মিথ্যে বলেছেন গিরীনবাবু, কারণ তিনি আপনাকে অত্যন্ত বেশিরকম স্নেহ করতেন।
ফেলুদা এবার তার ঝোলাটায় কুককেলভির ঘড়িটা আর ভিক্টোরিয়ার চিঠিটা ভরে নিয়ে, সেটা কাঁধে নিয়ে হতভম্ব মিঃ চৌধুরীর দিকে ফিরে বলল, আপনার সব ঘড়িতে এক সঙ্গে বারোটা বাজলে কেমন শোনায়, সেটা শোনার আর সুযোগ হল না। হবে হয়তো এক’দিন।