কুককেলভির ঘড়িটাকে মিঃ চৌধুরী উন্মাদের মতো ছুড়ে ফেলে দিলেন তার ডান পাশে খালি সোফাটার দিকে। আর তার পরেই তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন—
উইলিয়াম সাহাবকে বোলাও!—আর উয়ো রিভলভার দেও হামকো!
পেয়ারেলাল রিভলভারটা মিঃ চৌধুরীর হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিঃ চৌধুরী দু-একবার স্কাউণ্ডুল সুইন্ডলার ইত্যাদি বলে সোফা ছেড়ে উঠে অত্যন্ত অসহিষ্ণু ভাবে পায়চারি শুরু করলেন।
এবার পেয়ারেলাল সেই পিছনের দরজাটা দিয়ে আরেকটা লোককে সঙ্গে নিয়ে ঢুকল। আবছা অন্ধকারে দেখলাম কাঁধ অবধি লম্বা মাথার চুল আর ঠোঁটের দুপাশে ঝুলে থাকা গোঁফ। পরনে প্যান্ট, শার্ট আর সুতির কোটি।
কী ঘড়ি নিয়ে এসেছ তুমি কবর খুঁড়ে? বৰ্জগভীর গলায় প্রশ্ন করলেন মিঃ চৌধুরী। তিনি আবার সোফায় গিয়ে বসেছেন, তার হাতে এখনও রিভলভার, দৃষ্টি এখনও ফেলুদার দিকে।
যা পেয়েছি। তাই এনেছি, মিঃ চৌধুরী—আগন্তুক কাতর স্বরে জবাব দিল।আপনাকে ঠকিয়ে কি আমি পার পাব? আপনি এত বড় এক্সপার্ট!
তা হলে সে চিঠির কথা কি মিথ্যে? ঘর কাঁপিয়ে প্রশ্ন করলেন মহাদেব চৌধুরী।
তা কী করে জানব মিঃ চৌধুরী? ওটার উপর ভরসা করেই তো সব কিছু। এই তো সেই চিঠি—দেখুন না।
আগন্তুক একটা পুরনো চিঠি বার করে মিঃ চৌধুরীর হাতে দিল। চৌধুরী সেটায় চোখ বুলিয়ে বিরক্তভাবে সেটাকেও ছুড়ে ফেলে দিলেন পাশের সোফার উপর, আর ঠিক সেই সময় হেসে উঠল ফেলুদা। প্রাণখোলা হাসি। এমন হাসি ওকে অনেক’দিন হাসতে দেখিনি।
হাসির কী পেলেন। আপনি মিঃ মিটার? গির্জন করে উঠলেন মহাদেব চৌধুরী। কোনওমতে হাসিটাকে একটু চেপে ফেলুদা উত্তর দিল—
আপনার এত নাটকীয় আয়োজন সব ভেস্তে গেল দেখে হাসি পেল, মিঃ চৌধুরী।
চৌধুরী রিভলভার হাতে আবার সোফা ছেড়ে উঠে পুরু কর্পেটের উপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে এগিয়ে এলেন ফেলুদার দিকে।
আমার নাটক কি শেষ হয়ে গেছে ভাবছেন, মিঃ মিটার? আসল ঘড়ি যে আপনার কাছে নেই তার কী বিশ্বাস? আপনি তো গোরস্থানে অনেকবার গেছেন। আজও তো উইলিয়ামের আগে আপনি পৌঁছেছেন। আপনার কাছে ঘড়ি থাকলে সে ঘড়ি হাত না করে কি আমি ছাড়ব? আপনি যেখানে সেটা লুকিয়ে এসেছেন সেখান থেকে আপনাকেই সেটা বার করে দিতে হবে মিঃ মিটার। আর ঘড়ি যদিও নাও থেকে থাকে–এই চিঠি যদি মিথ্যে হয়ে থাকে–তা হলেও যে আমি আপনাকে ছেড়ে দেৰ এটা কী করে ভাবছেন? আপনার সব ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাসটা যে আমার পক্ষে বড় অসুবিধাজনক, মিঃ মিটার! কাজেই, নাটক ফুরিয়েছে কী বলছেন? নাটক তো সবে শুরু!
ফেলুদার গলায় এবার আমার একটা খুব চেনা সুর দেখা দিল। এটা ও নাটকের চরম মুহূর্তে ব্যবহার করে। লালমোহনবাবু বললেন, এ সূরটা নাকি ওঁকে তিব্বতি শিঙার কথা মনে করিয়ে (।
আপনি ভুল করছেন, মিঃ চৌধুরী। নাটক এখন আমার হাতে, আপনার হাতে নয়। এই মুহূর্ত থেকে আমি নাটকট চালাব। আমিই বিচার করব আপনাদের দুজনের মধ্যে কার অপরাধ বেশি-আপনার, না যিনি উইলিয়াম বলে–
ঘরে তোলপাড় ব্যাপার! উইলিয়াম একটা প্ৰচণ্ড লাফ দিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো পেয়ারেলালকে এক ঘুষিতে ধরাশায়ী করে বাইরের দরজার দিকে ধাওয়া করেছে। চৌধুরীর রিভলভারের গুলি তাকে হাত দু-একের জন্য মিস করে দরজার বা দিকের একটা দাঁড়ানো ঘড়ির কাচের ডায়াল খানখান করে দিল; আর সবাইকে অবাক করে সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গোল সেই জখম ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি।
মিস্টার উইলিয়ামকে ধরতে আরও দুজন লোক ছুটছে; কিন্তু তারা বেশি দূর যেতে পারল না। তাদের পথ আটকেছে কয়েকজন সশস্ত্ৰ লোক। তারা এবার উইলিয়াম সমেত সকলকে নিয়ে বৈঠকখানায় এসে ঢুকাল। সামনের ভদ্রলোককে দেখে বলে দিতে হয় না। ইনি একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর। সঙ্গে আরও পাঁচজন পুলিশ কনস্টেবল ইত্যাদি, আর সবার পিছন দিয়ে সংগ্রহে উঁকি দিচ্ছেন লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদ দত্ত।
সাবাস, হরিপদবাবু, বলল ফেলুদা।
আপনিই তো ফেলুমিত্তির? ঠিক লোকের দিকে চেয়েই প্রশ্নটা করলেন ইনস্পেক্টর মশাই! কী ব্যাপার বলুন তো? মিঃ চৌধুরীকে তো চিনি-কিন্তু ইনি কে, যিনি পালাচ্ছিলেন?
ফেলুদা এর উত্তর দেবার আগে হতভম্ব মহাদেব চৌধুরীর হাত থেকে নিজের রিভলভারটি অনায়াসে বার করে নিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, মিঃ চৌধুরী-এবার আপনি কাইন্ডলি আপনার নিজের জায়গায় গিয়ে বসূন তো। নাটকের বাকি অংশটা দেখার সুবিধে হবে। আর তা ছাড়া আপনাকে কালো মখমলে মানায় বড় ভাল। আর মিস্টার উইলিয়াম-ফেলুদার দৃষ্টি ঘুরে গেছে—আপনার চুল আর গোঁফটাতে কিন্তু আপনাকে হুবহু আপনার প্রপিতামহের মতো দেখাচ্ছে ও দুটো খুলবেন কি দয়া করে?
পুলিশ টান দিতেই উইলিয়ামের গোঁফ আর পরচুলা খুলে এল, আর অবাক হয়ে দেখলাম উইলিয়ামের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন নরেন বিশ্বাসের ভাই গিরীন বিশ্বাস!
এবার বলুন তো মিঃ বিশ্বাস, বলল ফেলুদা, আপনার পুরো নামটা কী?
কেন; আমার নাম আপনি জানেন না?
আপনার এখন দুটো নাম জানা যাচ্ছে। এই দুটো জুড়েই বোধহয় আপনার আসল নাম, তাই না? উইলিয়াম গিরীন্দ্ৰনাথ বিশ্বাস-তাই না? অন্তত প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনে গোলন্ড মেডালিস্টদের তালিকায় তো তাই বলছে। আর আপনার ভাইয়ের নাম বলছে মাইকেল নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। ভিজিটিং কার্ডের এম’টা হয়ে যাচ্ছে মাইকেল, তাই না? আপনারা বাংলা নামটা ব্যবহার করতেন বলেই বোধহয় নরেনবাবু ভিজিটিং কার্ডে এম. এন না ছেপে এন. এম ছেপেছিলেন-তাই না?